পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে দেশে তরল দুধের চাহিদা বাড়লেও বাড়েনি উৎপাদন। বিশেষ করে দুগ্ধশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু নিউজিল্যান্ড খ্যাত জনপদ শাহজাদপুরসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জে উৎপন্ন গরুর তরল দুধের চাহিদা সারাদেশে বহুলাংশে বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি দুধের উৎপাদন। বাঘাবাড়ি মিল্কশেড এরিয়ায় উৎপন্ন তরল দুধ দেশের মোট চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় দেড় লাখ লিটার। আর এই ঘাটতি পূরণের সুযোগে এক শ্রেণির মুনাফালোভী অসাধু দুধ ব্যবসায়ী, মধ্যসত্বভোগী ও ঘোষ সম্প্রদ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রণ করে ভেজাল ও নকল দুধ তৈরি করে বাড়তি চাহিদানুযায়ী ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। সংশ্লিষ্টৈদের নিয়মিত নজরদারীর অভাবে ওই অসাধু চক্রটি ছানার টক পানি, মিল্ক পাউডার, সয়াবিন তেল, হাইড্রোজ, লবন, কেমিক্যালসহ নানা ধরণের উপকরণ মিশিয়ে ভেজাল ও নকল দুধ দেদারসে তৈরি করছে।
অসাধু চক্রটি প্রথমে টাটকা দুধ থেকে ননী তুলে ননী দিয়ে ঘি তৈরি করছে, ননী বিহীন দুধ (টানা দুধ) দিয়ে কেউবা নিম্নমানের ছানা তৈরি করে সেটা শারাম দুধের ছানার দামে বিক্রি করছে; আবার অনেকে ননী বিহীন টানা দুধের সাথে সয়াবিন, চিনি ও কেমিক্যেল মিশিয়ে দুধের ঘনত্ব তৈরি করে খাটি বা শারাম দুধের দামে বিক্রি করছে। আবার অনেকে ড্রামকে ড্রাম ছানার টক পানি সংরক্ষণ করে সেই পানির সাথে ফরমালিন, কাটিং ওয়েলসহ মানবদেহের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে ভেজাল ও নকল তরল দুধ তৈরি করে দুধের বর্ধিত চাহিদা পূরণে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করছে। নানা অসাধু উপায়ে দুধে ভেজালকারী ওই চক্রটি এক দুধ তিন-চারবার বিক্রি করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন।
দেশের সর্ববৃহত সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রাথমিক সমবায় সমিতি লিমিটেড-মিল্কভিটা ও এ অঞ্চলের বিভিন্ন বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্ট কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি লিটার দুধের দামের চেয়ে ভেজাল ও নকল দুধ তৈরিকারী চক্রটি অবৈধ পন্থায় তাদের উপার্জিত বিপুল অবৈধ অর্থের দাপটে রমজানে গো-খামারীদের দুধের দাম লিটারপ্রতি বেশী দিয়ে দুধ ক্রয় করে তার সাথে ভেজাল মিশ্রণ করে অতিরিক্ত চাহিদার এক দেড় লাখ লিটার নকল ও ভেজাল দুধ তৈরি করে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করছে।
এতে, এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত নকল ও ভেজাল দুধ খেয়ে দেশের শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে নানান জটিল রোগে; তাদের জীবন ও ভবিষ্যত বিপন্ন হতে চলেছে। অন্যদিকে, ভেজালকারীদের অবৈধ ও অনৈতিক দৌরাত্ব আর দাপটে দুগ্ধ ব্যবসায়ের ভরা মৌসুমে মিল্কভিটার বাঘাবাড়ি ও মোহনপুর কারখানায় দুধ সংগ্রহের হার আশংকাজনক হারে কমে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে মিল্কভিটা! গত ২০০৮ সালের পর দু’এক বছর নকল ও ভেজাল দুধ তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত নিয়মিত অভিযান চালিয়ে তাদের কোনঠাঁসা করলেও গত প্রায় ১ যুগে নকল ও ভেজাল দুধ তৈরিকারী অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। ফলে ভেজালকারীদের সংখ্যা ও দৌরাত্ব শংকাজনক হারে বেড়েছে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী বড়াল নদীর উত্তর পাশে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্কভিটা) এর প্রধান কারখানা। মিল্কভিটা’কে কেন্দ্র করে বাঘাবাড়ি মিল্কশেড এরিয়ায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৪২ সহস্রাধিক গো-খামার। এসব গো-খামারে প্রতিদিন গড়ে চার লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। এছাড়া বাঘাবাড়ি মিল্কসেড এরিয়ার পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই গাভী লালন-পালন করা হয়। এসব গাভী থেকেও দৈনিক আরো প্রায় এক লাখ থেকে সোয়া লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। দৈনিক উৎপন্ন পাঁচ থেকে শোয়া পাঁচ লাখ লিটার গরুর দুধ মিল্কভিটা’সহ বেসরকারি নানা ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টার, ঘোষ সম্প্রদায়সহ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে খামারিরা বিক্রি করে আসছেন।