সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে নারীর শিক্ষা ও কাজের পরিধি। তৈরি হচ্ছে আয়ের নতুন মাধ্যম। কিন্তু এর একটি অন্ধকার দিক হল ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাড়ছে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা। এ প্রেক্ষিতে গবেষণাভিত্তিক এডভোকেসি প্রতিষ্ঠান ভয়েস ফর ইন্টারএকটিভ চয়েস এন্ড এমপাওয়ারমেন্টের (ভয়েস) আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ”ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীর প্রতি সহিংসতারোধে করনীয়” শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভা। সাংবাদিক, এনজিও ও মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক ও আইন বিষয়ক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ”প্রমোটিং উইমেনস ইকুয়ালিটি এন্ড রাইটস” প্রকল্পের অংশ হিসেবে আয়োজিত এ সভায় অংশগ্রহণ করেন ।
সভায় বক্তারা বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে যৌন হয়রানি মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার হল জনসচেতনতা। অনলাইন সহিংসতার বিভিন্ন ধরন, এর প্রভাব এবং সম্পৃক্ত আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারাভিযান, কর্মশালা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম চালানো জরুরি। ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দিয়ে অনলাইনে যৌন সহিংসতার ক্ষতিকর প্রভাব সর্ম্পকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভুক্তভোগীদের সমর্থন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যকে সহজলভ্য করতে হবে।
মো. মোহাইমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন), সিআইডি, বলেন, ”তদন্ত পরিচালনার প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো ধাপ আছে যেমন ডিভাইসটি জব্দ করা, ফরেনসিকে পাঠানো, সংশ্লিষ্ট মাধ্যম যেমন ফেইসবুকের সাথে যোগাযোগ করা। দূর্ভাগ্যবশত, আমাদের কাছে যেসব মামলা আসে তার সংখ্যা অতি নগন্য, অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত হয় না।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ নাভিলা কাশফি বলেন, ”ভুক্তভোগী নারীরা মামলা করেন ঠিকই কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার কারণে এক পর্যায়ে যেয়ে আপোষ করতে বা মামলা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হন। সেক্ষেত্রে আইনজীবীদের মামলা পরিচালনায় আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায় না।”
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক সুলতান মাহমুদ সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে বলেন, ”ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক যে প্রতিবেদনগুলো হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে জেন্ডার ও মানবাধিকারের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য থাকা জরুরী।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ মাহমুদ স্বপন। তিনি বলেন, ”বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে অনলাইনে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনে নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা জরুরী। এক্ষেত্রে কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষন করতে হয়, অনলাইন অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখা যায় এবং অনলাইনে হুমকি চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করা যায় তার জানতে বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। এছাড়াও নারীদের জন্য এমন কিছু পরিসর তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে নারী তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারবে, এতে তাদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হবে ও ডিজিটাল সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।”
সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভয়েসের উপ-পরিচালক মুশাররাত মাহেরা। সচেতনতা ও তথ্যের অভাব, পুরুষতান্ত্রিক প্রথা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত সার্বিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব — এই তিনটিকে নারীর প্রতি সাইবার অপরাধ দমনে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ”নারীর প্রতি বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক কট্টর মানসিকতার কারণে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আমলে ন্ওেয়া হয় না। অপরাধীরাও একারণে বিচারের আওতায় আসে না ও সহিংসতার দুষ্টচক্র চলমান থাকে। গণমাধ্যমেও প্রচারকৃত বিষয়বস্তু অনেক ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল হয় না।”
সাইবার পরিসরে নারীদের লক্ষ্য করে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে রয়েছে সাইবারস্টকিং বা পিছু নেয়া, ঘৃণাসূচক বক্তব্য, মর্ফিং (কোন নারীর ছবি বিকৃত করা, ফেইক প্রোফাইল তৈরি করা, যৌন উত্তেজক ক্ষুদেবার্তা পাঠানো), ইমেল আইডি হ্যাক করা, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি প্রকাশ বা ব্ল্যাকমেইলিং, হুমকি, ইমপার্সোনেশন বা ক্যাটফিশিং (ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা), ডক্সিং (নারীর ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইল, পারিবারিক তথ্য অনলাইনে ফাঁস) ইত্যাদি।
সাইবার স্পেসে নারীদের হয়রানির সমাধানকল্পে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন কার্যক্রম শুরু করে ২০২০ সালে। গত সাড়ে তিন বছরে (২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত) তাদের কাছে সাইবার অপরাধের শিকার ৬০ হাজার ৮০৮ জন নারী প্রতিকার চেয়েছেন। সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগী এসব নারীর ৪১ ভাগই ডক্সিংয়ের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ১৮ ভাগ ফেইসবুক আইডি হ্যাক, ১৭ ভাগ ব্ল্যাকমেইলিং, ৯ ভাগ ইমপার্সোনেশন, ৮ ভাগ সাইবার বুলিংজনিত সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পারেন না কী করবেন বা কোথায় গেলে প্রতিকার পাবেন। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে অভিভাবক বা পরিচিতজনকেও জানাতে চান না।
অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মেয়ে নেটওর্য়াকের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক তৃষিয়া নাশতারান, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি-র উপদেষ্টা শারাবন তহুরা ও আদিবাসী অধিকারকর্মী ডালিয়া চাকমাসহ প্রমুখ।