কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মার পানি আরও বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেড় হাজারের বেশি পরিবারের বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী, উপজেলার চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৩৮ গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তলিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল।
সোমবার বিকেলে ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পেরিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। স্থানীয়রা বালির বস্তা দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বুধবার অথবা বৃহস্পতিবারের মধ্যে উপজেলার অর্ধেক অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণিকক্ষগুলো খোলা রাখা হয়েছে।
ভারতে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে রেকর্ড বৃষ্টিতে উপচে পড়ছে বাঁধের জল। ফলে ফারাক্কা বাঁধের সব কয়টি লকগেট এক সঙ্গে খুলে দিয়েছে ভারত। সোমবার ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি লকগেট খুলে দেয়ায় দ্রুত পানি বাড়ছে পদ্মায়। এতে কুষ্টিয়ার চরাঞ্চল প্লাবিত করে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসছে পানি। একইসঙ্গে গত তিনদিনের টানা বর্ষণের বন্যা দুর্গত মানুষের সীমাহীন কষ্টের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৬ বছর পর বিপদসীমা অতিক্রম করে পদ্মার পনি বিপদসীমার পয়েন্ট ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। পদ্মা নদীতে পানির বিপদসীমা হচ্ছে ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। সেখানে মঙ্গলবার বিকেলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে ১৪ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটার।
সোমবার পানির মাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। রোববার ছিল ১৩ দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার। গড়ে প্রতি দিন ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। সর্বশেষ পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রধান শাখা গড়াই নদেও অব্যহতভাবে পানি বাড়ছে।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে গড়াইয়ের পানি প্রবাহিত হচ্ছে ১২ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার। গড়াই নদীর বিপদসীমা হচ্ছে ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। বিপদসীমা থেকে মাত্র পয়েন্ট ৩২ সেন্টিমিটার দূরে। পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রধান শাখা গড়াই নদেও অব্যহতভাবে পানি বাড়ছে।
গড়াইয়ে পানি বাড়ায় জিকে ঘাট ছাড়াও বড় বাজার এলাকার বেড়িবাঁধের পাশে বেশ কিছু ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। পানি বাড়তে থাকলে কুষ্টিয়া রক্ষা বাঁধসহ অন্যান্য স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুত নিচ্ছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযুষ কৃষ্ণ কুন্ডু বলেন, পানি এই মুহূর্তে বিপদসীমার কয়েক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পর ভেড়ামারা উপজেলার মোসলেমপুরে পানি ঢুকছে। এছাড়া কুষ্টিয়া শহর, কুমারখালী ও খোকসার কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করে ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে। আমাদের টিমের সদস্যরা সর্বক্ষনিক মনিটরিং করছে।
সরোজমিনে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। আকস্মিক বন্যায় মাঠের ফসলের সঙ্গে সঙ্গে মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুতেও পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়ির উঠান ও ঘরের মধ্যে পানি ঢুকে পড়ায় বাড়িতে বাস করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঘরের ভেতরে বাঁশের মাচা ও নৌকার ওপর অনেককে বসে থাকতে দেখা গেছে। অনেকের বাড়িতে রান্না করার জায়গাটুকুও ফাকা নেই। পানি বেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
দুইদিন আগেও যেসব এলাকা শুকনা ছিল। এখন সেখানে পদ্মার পানিতে থৈই থৈই করছে। যেদিকে চোখ পড়ে শুধু পানি আর পানি। চলার রাস্তা ঘাট সব জায়গায় পানি। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৩৮ গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষের বের হওয়ার কোন উপায় নাই। নৌকাই তাদের চলার একমাত্র অবলম্বন। টানা বৃষ্টির ফলে ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না মানুষ। অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর হওয়ায় সেখানে খাবার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। বৃদ্ধ শিশু ও নারীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
মরিচা ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর জানান, তার ইউনিয়নের ভুরকা এলাকায় স্লুইচ গেট ভেঙ্গে পদ্মার পানি ঢুকে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে কৃষকের বিভিন্ন ধরনের ফসল ও বাড়ি-ঘর।
ফিলিপনগর ইউনিয়নের ইসলামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহিউদ্দিন জানান, ফিলিপনগর বড়মসজিদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকা দিয়ে বাঁধ উপচে বন্যার পানি ঢুকতে থাকলে বালির বস্তা দিয়ে এলাকাবাসী তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
মঙ্গলবার দুপুরে রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আ.ক.ম সারওয়ার জাহান বাদশা ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন। এসময় বন্যাদুর্গত ১৫’শ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন তারা।
জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, নদীর পানির উচ্চতা বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিনিয়ত রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রতি ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে আছে। বন্যাকবলিত পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রস্তত রয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও ত্রাণ আনা হবে।
দৌলতপুর আসনের সাংসদ অ্যাড. সারওয়ার জাহান বাদশাহ বলেন, পদ্মায় হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় ৪ ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রতিনিয়ত তাদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।