পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদীর পানি বেড়ে যে বন্যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ অতিবর্ষণ; ফারাক্কা বাঁধ নয়।
মঙ্গলবার মতিঝিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া এ কথা বলেন।
টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি এবং উজানে পানি বাড়ায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পদ্মা অববাহিকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও নাটোর অঞ্চলে স্বল্পকালীন বন্যা হতে পারে বলে আগেই আভাস দিয়েছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা।
এর মধ্যে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা দেখা দেওয়ায় গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি গেইটের সবগুলোই সোমবার খুলে দেয় ভারত।
এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ভারতের পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে এবং ফারাক্কা খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশেও বন্যা দেখা দিতে পারে।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, “এই যে বন্যা পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে আসলে ভারতীয় অংশের ফারাক্কা বাঁধের কোনো প্রভাব নেই। এই মৌসুমে ভারত অংশের ফারাক্কা বাঁধের গেইটগুলো খোলাই থাকে। এই সময় নদী যে আচরণ করে তা খুবই স্বাভাবিক আচরণ।”
তিনি বলেন, গত জুলাই মাসের বন্যাও হয়েছিল ভারী বৃষ্টির কারণে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে এখন একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
“বাঁধের একাংশ ওইখানে আগে থেকেই খোলা ছিল। এখন আমাদের দেশে যে পানিটা আসছে সেটা বৃষ্টিপাতের কারণে।”
ভারী বৃষ্টির কারণে ভারতের বিহারের পাশাপাশি পশ্চিমঙ্গের কিছু এলাকাতেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে আরিফুজ্জামান বলেন, “ভাটির দেশ হওয়ায় সেই পানিটা অবশ্যই আমাদের অংশের নদ-নদী দিয়ে প্রভাহিত হবে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে আমাদের মধ্যাঞ্চল হয়ে পানিটা নেমে যাবে। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।”
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সুরমা ও কুশিয়ারা ছাড়া দেশের প্রায় সব প্রধান নদ-নদীর পানির সমতলই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পদ্মা নদী মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার, পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল। আর গড়াই নদী কুষ্টিয়ার কামারখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার এবং খুলনায় পশুর নদ বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল।
গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার নদীগুলোর পানি বৃদ্ধির এই প্রবণতা আগামী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে এবং ভাগ্যকূল পয়েন্টে পদ্মার পানি সমতল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, নদ-নদীর পানি বাড়ায় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নাটোর ও পাবনা এবং মধ্যাঞ্চলে ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরিয়তপুরসহ আশেপাশের এলাকাগুলোয় মাঝারি মাত্রার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
“মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারে গত সপ্তাহজুড়ে আমরা ভারী বৃষ্টিপাত দেখেছি। এর প্রভাবে ভারতীয় অংশে গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ইতোমধ্যে সেখানে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
“বাংলাদেশেও গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি গত বেশ কয়েকদিন ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ সকালে চারটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।”
ভারত ও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তদের বরাত দিয়ে আরিফুজ্জামান বলেন, “ভারতীয় অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আজ থেকে কমে আসবে। তবে আরও চার-পাঁচদিন অব্যাহত থাকবে। এরপর এখানে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করবে।”
সেক্ষেত্রে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী।
ফারাক্কা নিয়ে এক প্রশ্নে আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, “বাঁধের মূল কাজ হল শুকনো মৌসুমে। জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়টায় পানির স্বল্পতা থাকে। তখন সেই পানিটা ধরে রাখার জন্য এই বাঁধ সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাঁধ মূলত কাজ করে তখন। নদ-নদীতে যখন পানি বাড়ে তখন আর বাঁধের গেইট বন্ধ রাখা যায় না, খুলে দিতে হয়।”
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ‘প্রচারিত ও প্রকাশিত বিভ্রান্তি’ দূর করতে সোমবার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
সেখানে বলা হয়, “ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়া এবং সেজন্য বন্যার আশঙ্কা রয়েছে- এমন একটি সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, প্রতি বছরই জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধের গেইটগুলো খোলা থাকে। এটি নিয়মিত ব্যবস্থাপনারই অংশ।”
গত কয়েকদিন ধরে গঙ্গা, পদ্মা অববাহিকার উভয় অংশে ‘নিম্নচাপজনিত অতিবৃষ্টির’ ফলে নতুন করে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সে কারণেই উজানে ভারতের বিভিন্ন জেলায় ও ভাটিতে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এবার ভরা বর্ষায় জুলাই মাসে টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি এবং উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জসহ ২৮টি জেলা প্লাবিত হয়। বন্যায় শতাধিকের মৃত্যুর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩০ লাখের বেশি মানুষ।
আশ্বিনের মাঝামাঝিতে এসে মৌসুমি বায়ু বিদায়বেলায় প্রায় প্রতিদিনই সারা দেশে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১৯০ সেন্টিমিটার, মহেশখোলায় ১২০ সেন্টিমিটার ও দিনাজপুরে ১১৭.৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।