Home > বিশেষ সংবাদ > কানাডা প্রবাসী তারেক রানাই কি বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ তানভীর জয়!

কানাডা প্রবাসী তারেক রানাই কি বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ তানভীর জয়!

তারেক রানা নামের কানাডা প্রবাসী এক ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার। এতে বলা হয়, এই তারেক রানাই বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ হিসেবে ‘খ্যাত’ তানভীর ইসলাম ওরফে জয়।

অবশ্য তারেক রানার দাবি, তিনি কিছুতেই খোন্দকার তানভীর ইসলাম ওরফে জয় নন!

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, দুজনের (তারেক রানা ও তানভীর জয়) মধ্যে কী ভীষণ মিল! নামে, ছবিতে ও শরীরী চিহ্নে। পিতৃ পরিচয়ে এবং জন্মতারিখসহ সবকিছুতে আশ্চর্য রকমের মিল।

বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভীরের সঙ্গে তার এত মিল যে তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে, সে কথাও জানিয়েছিলেন তারেক রানা। কিন্তু কলকাতা থেকে ২০১৪ সালে কানাডায় যাওয়া তারেক রানা পালিয়ে গেছেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।

এতে বলা হয়, তারেক রানা বর্তমানে ‘লাপাত্তা’! ফলে বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দারা তো বটেই, খোদ ইন্টারপোলও নিশ্চিত- তাদের জারি করা ‘রেড নোটিশ’ যার বিরুদ্ধে, সেই খোন্দকার তানভীর ইসলাম এবং কানাডার প্রতিশ্রুতিমান উদ্যোক্তা তারেক রানা আদতে একই ব্যক্তি।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ হিসেবে ‘খ্যাত’ জয় সে দেশে কয়েক ডজন খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণে মামলায় অভিযুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অনুরোধে ইন্টারপোল ‘রেড নোটিশ’ জারি করে তার বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ পুলিশের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, ওই সময়েই তারা জয়ের মাথার দাম রেখেছিল ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কুখ্যাত সেভেন স্টার গ্যাংয়ের পাণ্ডা তিনি। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা আদায় করে ‘সেভেন স্টার গ্যাং’। টাকা না দিলে খুনও করতে পিছপা হতো না তারা।

বাংলাদেশ পুলিশের বরাত দিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, ২০০৬ সালের ১৪ মে বিদেশে কাজের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া সংস্থা ‘তুর্কি অ্যাসোসিয়েট’-এর মালিককে ৮ লাখ মার্কিন ডলার চেয়ে ফোন করেন জয়। টাকা না দেওয়ায় ওই সংস্থার অফিসে ঢুকে ছয়জনকে গুলি করে খুন করে তার দলবল। জয় তখন সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে টাকা চেয়েছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০০৭ সালে কলকাতার বাগুইআটির চিনার পার্কের একটি বাড়ি থেকে জয়কে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সিআইডি। ভোল বদলে তারেক রানা নামে তিনি গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন বাগুইআটির ওই ভাড়াবাড়িতে। ভুয়ো নথির মাধ্যমে তারেক রানা নামে তিনি তত দিনে ভারতীয় পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স- সবই জোগাড় করে ফেলেছেন। ভারতে তার পরিচয় তখন ‘জি ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক সংস্থার মালিক!

সিআইডি তার বিরুদ্ধে পাঁচটি আলাদা আলাদা মামলা রুজু করে। ওই সময় সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস) ছিলেন সিআইডির বর্তমান এডিজি রাজীব কুমার। তার নেতৃত্বেই তৈরি হয় স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। তারাই গ্রেপ্তার করে জয়কে।

এই মামলাগুলো যখন চলছিল, তখনই জয়কে ফেরত পেতে ভারতকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। ওই সময়ে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আনন্দবাজারকে জানান, ওই প্রত্যর্পণ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জামিন পেয়ে যান জয়। এর পর জয়ের আর কোনো ‘খোঁজ’ পাওয়া যায়নি।

কানাডার অভিবাসন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে পর্যটক ভিসা নিয়ে সে দেশে তারেক রানা নামে এক ব্যক্তি যান। সেই তারেক রানাকেই ২০১৪ সালে কানাডার অভিবাসন দপ্তর ১০ বছরের ভিসা দেয়। তখন থেকেই তিনি সেখানে আছেন।

ইতোমধ্যে কানাডার টরোন্টোর শহরতলি আয়াক্সে ওই ‘ভারতীয়ের’ নাম একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারেকের দাবি, তার জন্ম থেকে বড় হওয়া- সবটাই কলকাতায়।

আয়াক্সের অভিজাত এলাকায় তার ‘এসজে ৭১’ সংস্থার বিশাল অফিস রয়েছে। নিয়মিত তাকে সেখানকার ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা যায়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের অর্থসাহায্য করেন তিনি। এমনকি সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলেও দেন মোটা চাঁদা।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তারেককে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি সে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এনেছেন বিনিয়োগও।

সম্প্রতি ‘এসজে ৭১’র ডিরেক্টর তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভীরের সঙ্গে সব রকম মিল খুঁজে পেয়েছে কানাডা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দারা নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছেন-

১. ২০০৫ সালে খোন্দকার তানভীর ইসলাম ওরফে জয়ের যে ছবি ইন্টারপোলের রেড নোটিশে রয়েছে, তার সঙ্গে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া জয়ের ছবি এবং তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবিতে সাদৃশ্য রয়েছে।

২. খোন্দকার তানভীরের বাবার নাম এবং তারেক রানার বাবার নাম একই- খোন্দকার নজরুল ইসলাম।

৩. খোন্দকার তানভীর এবং তারেক রানার জন্মসাল একই দুজনেরই ১৯৬৭ সালে জন্ম।

৪. অতীতে দুজনেরই দুই পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার চিহ্নও দুজনের শরীরে রয়েছে।

শুধু কানাডার অভিবাসন দপ্তর নয়, সিআইডির কর্মকর্তারা যারা জয়কে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেপ্তার করেছিলেন, তারাও কানাডার তারেক রানার ছবি দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারছেন। তারা নিশ্চিত, বাংলাদেশের কুখ্যাত ডন খোন্দকার তানভীর ইসলামই আসলে এই তারেক রানা।

কানাডার এই উদ্যোক্তা প্রথমে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতেই রাজি হননি। গত অক্টোবরে শেষবার যখন কথা হয়, তখনো তিনি কানাডাতে। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্প্রতি এটা আমারও অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। ওই অপরাধীর সঙ্গে আমার মুখের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। এখানকার পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’

একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘তবে, আমি তানভীর ইসলাম জয় নামে কাউকে চিনি না।’

তাকে কি কখনো কলকাতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল- এমন প্রশ্নে তারেক দাবি করেন, জীবনে কখনো কোনো অপরাধের সঙ্গে তার যোগ ছিল না। ফলে গ্রেপ্তারের প্রশ্নই নেই।

তা হলে কলকাতা হাইকোর্টে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে খোন্দকার তানভীর ইসলাম জয় ওরফে তারেক রানা (সিআরআর ২৮৮৭/২০০৭) হিসেবে তিনি কেন তার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলা মামলা খারিজ করার আবেদন জানিয়েছিলেন? সেখানে তো তারেক রানার সঙ্গে মোস্ট ওয়ান্টেড খোন্দকার তানভীর ইসলাম জয় নামটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব অক্টোবরের ওই কথোপকথনের সময়ে তারেক দেননি।

তাকে এটাও ওই সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ওই মামলার নথি থেকে হদিস মিলেছে, তারেকের যে ভারতীয় পাসপোর্ট (এফ ১১১৫১৩৪) তা আসলে ভুয়ো নথি দিয়ে বানিয়েছিল তিনি। সিআইডি আদালতে তেমনটাই জানিয়েছিল। এবারও নিরুত্তর ছিলেন তারেক। আর সিআইডি বলছে, ওই ভুয়ো পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তারেক রানা কানাডা যাওয়ার জন্য ১০ বছরের ভিসা পেয়েছিলেন!

অক্টোবরে তারেকের সঙ্গে যে দিন কথা হয়, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কানাডার অভিবাসন দপ্তর একাধিকবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর পর হঠাৎ করেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান।

কানাডায় তার পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে তিনি ফিরবেন আয়াক্সে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন জানতে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

তবে ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, তারেক রানা বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রয়েছেন।

কানাডা পুলিশ জানাচ্ছে, তার আয়াক্সের অফিস তালা বন্ধ। পাওনাদাররা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছে।

মোস্ট ওয়ান্টেড ডন হয়ে গেলেন কানাডার ‘প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোক্তা’ তারেক রানা! কানাডার প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা। সম্প্রতি কানাডার একটি শহরে পৌর প্রশাসনের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।

ডন থেকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেও গোয়েন্দা চোখের আড়ালে যাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনই ফেরার হয়ে নিজেকে লুকানোও ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে তারেকের। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই তার মোবাইল নিষ্ক্রিয়। ই-মেইলও অকার্যকর রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে- তারেক যদি মোস্ট ওয়ান্টেড জয় না-ই হন, তবে নিজের এত বড় ব্যবসা ফেলে কেন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেলেন!