Home > জাতীয় > সারাদেশ > ১৫ কোটি টাকার ১০ কোটি লুটপাট, তদন্তে দুদক

১৫ কোটি টাকার ১০ কোটি লুটপাট, তদন্তে দুদক

হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই ১৫ কোটি টাকার টেন্ডারের ১০ কোটিই লুটপাটের ঘটনা তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দুদকের হবিগঞ্জের সহকারী পরিচালক মো. এরশাদ মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের দুর্নীতির তদন্ত করে।

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের দুর্নীতির বিষয়ে গত ২৫ নভেম্বর ‘দেড় লাখ টাকার বোর্ড ১৫ লাখ টাকা’ শিরোনামে জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশ হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ওই কলেজের দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ হয়। এর প্রেক্ষিতে দুদকের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের দুর্নীতির বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার সকালে তদন্তে আসে দুদক। তদন্তের পর টেন্ডার-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে যায় দুদকের টিম।

এ বিষয়ে দুদকের হবিগঞ্জের সহকারী পরিচালক মো. এরশাদ মিয়া বলেন, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ১৫ কোটি টাকার টেন্ডারের দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। সংবাদগুলো দুদকের ঊধ্বর্তন কর্তপক্ষ পর্যবেক্ষণ করেছেন। একই বিষয়ে দুদকের ১০৬ নম্বরে হবিগঞ্জ থেকে অভিযোগ করা হয়। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা মেডিকেল কলেজে তদন্ত করতে আসি।

তিনি বলেন, তদন্তকালে মেডিকেলের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ানকে কলেজে পাওয়া যায়নি। তবে টেন্ডার-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র আমরা নিয়ে এসেছি। এগুলোর বাজার দর যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ লক্ষ্যে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. শাহীন ভূঁইয়াকে সভাপতি করে তিন সদস্যবিশিষ্ট বাজারদর যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। দরপত্রে অংশ নেয় সাতটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মূল্যায়ন প্রতিবেদনে সদস্যদের স্বাক্ষর ছাড়াই ঢাকার শ্যামলী এলাকার বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ ও মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের ‘পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব মালামাল কেনায় বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৪৮ টাকা। মালামাল কেনা বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১০৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কেনা মালামালের মূল্য পাঁচ কোটি টাকা। বাকি টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এমনটাই জানিয়েছে দরপত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র।

সূত্রমতে, সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোরআই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য ধরা হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়।

৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টারের (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ) দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯০০ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের এর কোনো স্টিকার লাগানো নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, পাঁচটি স্টিলের আলমারি ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ও ৬ হাজার ৪৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা।

এছাড়া বিলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা দেখানোসহ দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫৫০ টাকা।

এদিকে, মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা।

পুনম ইন্টারন্যাশনাল এসির দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য ৮৫ হাজার টাকা। এরকম ছয়টি ফ্রিজ কেনা হয়েছে।

পাশাপাশি ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রের দাম নেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে। এছাড়া মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি সংবলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮০০ টাকা দরে।

এ রকম ৪৫০টি চার্ট কেনায় ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ‘স্টারবোর্ড‘ নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ বোর্ড। কিন্তু একই কোম্পানি ও মডেলের এই ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। এ যেন এক তুঘলকি কাণ্ড।