সদা হাস্যোজ্জ্বল রুম্পা। জীবন নিয়ে হয়তো তার স্বপ্ন ছিল, সাধ ছিল। কিন্তু সব স্বপ্ন সাধই অঙ্কুরে মিইয়ে গেল। অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের টার্গেটে রুম্পা জীবন দিতে হলো। পুরো নাম রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষাথী। বুধবার রাতের কোন এক সময় তাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তার লাশ উদ্ধার করা হয় দুই ভবনের মাঝ থেকে।
কিন্তু এ খুনের পেছনে রয়েছে কারা? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র। অবশ্য রহস্য উদঘাটনে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। প্রাথমিকভাবে এক বয়ফ্রেন্ডকে রাখা হয়েছে সন্দেহের তালিকায়। গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে এ বয়ফ্রেন্ড। যে বাসা থেকে তাকে নিচে ফেলা হয়েছে ওই বাসাটিও চিহ্নিত করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে কী-কারণে ওই হত্যাকাণ্ড? ওই বয়ফ্রেন্ড ছাড়া আর কারও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কী-না তা তদন্ত করা হচ্ছে। রুম্পা স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির কালচারাল সংগঠন ‘স্ট্রে বার্ড’ এর সদস্য ছিলেন।
রুম্পার সহপাঠীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, রুম্পার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। কিছুদিন ধরে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের পর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও মুষড়ে পড়েছেন। ওই বর্বর ঘটনার বিচার দাবি করে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। তারা প্রশাসনের কাছে কয়েক দফা দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার রাতে রমনা থানাধীন ৬৪/৪ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের গলি থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণীর মেরুদণ্ড, বাঁ হাতের কনুই ও ডান পায়ের গোড়ালি ভাঙা। মাথা, নাক, মুখে জখম এবং রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তাকে ধর্ষণ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। প্রথমে রুম্পার লাশ অজ্ঞাত হিসাবে উদ্ধার হওয়ায় রমনা থানার এসআই আবুল খায়ের বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত নামাদের আসামি করা হয়েছে।
মামলা তদন্তের প্রধান সমন্বয়কারী পুলিশের রমনা জোনের এসি এসএম শামীম মানবজমিনকে জানান, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। থানা পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা খুনীদের চিহ্নিত ও আইনের আওতায় আনার জন্য মাঠে কাজ করছে।
গতকাল দুপুরে ৬৪/৪ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের গলিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩ টি ভবন রয়েছে। একটি বামে, একটি সোজা এবং একটি ডানে। সবগুলোর করিডোর আটকানো। শুধু আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স এর সপ্তমতলা এবং দশম তলার করিডোর দিয়ে কাউকে ফেলা যেতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। অথবা বাকি দুই বাসার ছাদ থেকে তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। ওই তিন ভবনে একাধিক ছেলে ও মেয়েদের মেস রয়েছে।
তারা অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। দুই বাসার পেছনে ও আয়শা শপিং কমপ্লেক্সের মধ্যেখানে তার লাশ পড়ে ছিল। ঘটনাস্থলের বাসার কেয়ারটেকার সুমন জানান, ওপর থেকে কে বা কারা তাকে যখন ফেলে দেয় তখন আমরা শব্দ পেয়েছি। কাছে গিয়ে দেখি একজন তরুণীর রক্তাক্ত দেহ। অনেকজন সেখানে জড়ো হলে তাকে কেউ চিনতে পারেনি। পরে পুলিশকে খবর দিলে তার লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তবে আরেকজন কেয়ারটেকার জানান, ওই তরুণীকে তিনি সিদ্বেশ্বরী এলাকায় কয়েকবার দেখেছেন। এছাড়াও একজন তরুণের সঙ্গে রিকশায় করে আয়শা কমপ্লেক্স এর সামনে একদিন নামতে দেখেছেন।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রমনা থানার এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি শুরু থেকেই রহস্যেঘেরা। পুলিশ শুরুতে ওই তরুণীর লাশ অজ্ঞাত হিসাবে উদ্ধার করে। পরে থানা পুলিশ আশপাশের ভবন ও এলাকায় তরুণীর পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মাঠে নামে। কিন্তু, কেউ তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি। এসময় পুলিশের ধারণা হয় যে, ওই তরুণী হয় ওই এলাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তবে পুলিশ আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিন ভবনের কোন একটি ভবন থেকে তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মর্গে রুম্পার লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গোয়েন্দারা খুনীদের চিহ্নিত করার জন্য মাঠে নেমেছে। গতকাল সকালে সিদ্ধেশ্বরীর স্টামফোর্ড ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে রুম্পার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে ঢাকা মহানগর পূর্বের গোয়েন্দা পুলিশ ও রমনা থানা পুলিশের একটি দল। রুম্পা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মোবাইল ফোনটিও রেখে গিয়েছিলেন। ওই মোবাইল ফোনটি জব্দ করেছে তদন্তকারীরা।
সূত্র জানায়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে ‘স্ট্রে বার্ড’ নামে একটি কালচারাল সংগঠনের সদস্য হন রুম্পা। রুম্পা ছিলেন ভাল অভিনেত্রী। হাঁসি ও খুশিতে সর্বক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। তার হত্যাকাণ্ডে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছেন নিহতের সহপাঠীরা। নিহতের এক সহপাঠী জানান, রুম্পার সঙ্গে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্ক কিছুদিন ধরে টানাপড়েনের মধ্যে ছিল। এতে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল।
সূত্র জানায়, ওই বয়ফ্রেন্ড অন্য এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলো। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শেখ নাহিদ নিয়াজ জানান,‘রুম্পা খুব ভাল মেয়ে ছিল। সে কোন ক্লাস মিস দিতো না। সর্বক্ষণ হাসিখুশি থাকতো। তার এ ঘটনা শুনে আমরা ব্যথিত হয়েছি। এ ঘটনার যারা দোষি তারা কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হোক এটাই আমরাদের চাওয়া।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরিফুর রহমান জানান, ঘটনার পর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রুম্পার সকল নথি নিয়ে গেছেন। আমরা তদন্তে পুলিশকে সকল সহযোগিতা করবো। পারিবারিক সূত্র জানায়, লাশের ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের পরিবারের সদস্যরা তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বিজয়নগরে নিয়ে যান। এসময় রুম্পার স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেখানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: রুম্পার মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ করেছেন তার সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ১১ টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। পরে তারা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষোভ মিছিলটি সিদ্ধেশ্বরী থেকে বেইলি রোডের ভিকারুননিসা স্কুলের সামনে এসে শেষ হয়। সেখানে সমাবেশে তারা রুম্পা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানান। সূত্র: দৈনিক মানবজমিন