Home > ধর্ম > মসজিদে জমি দিলেন হিন্দু, শ্মশানে জমি দিলেন মুসলমান

মসজিদে জমি দিলেন হিন্দু, শ্মশানে জমি দিলেন মুসলমান

বাগেরহাটের ফকিরহাটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়লেন প্রণব কুমার ঘোষ ও মিজানুর রহমান। মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন প্রণব ঘোষ, আর শ্মশানের জন্য জমি দিয়েছেন মিজানুর রহমান। বিপরীত ধর্মের উপসনালয়ের জন্য জমি দানকে মহত্ব হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সম্প্রতি তাদের সম্মাননা দিয়েছে বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থা। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে নেটিজেন ও স্থানীয়রা তাদের প্রশংসা করতে থাকেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফকিরহাট বিশ্বরোড-সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন কোনো মসজিদ ছিল না। স্থানীয় মুসল্লিরা অনেক দূরের মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেন। মুসলমানদের এই সমস্যার সমাধানে ২০০৯ সালে মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় মসজিদ নির্মাণের জন্য ৩৫ শতক জমি দেন ফকিরহাট কাজি আজহার আলি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ। জমি বাবদ নাম মাত্র মূল্য নেন তিনি। এরপর থেকে স্থানীয় মুসল্লিরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন। এছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের ব্যাপারেও উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে তিন বছর আগে একই এলাকায় ভৈরব নদের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের শ্মশান। ফলে শেষকৃত্য করতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছিল সনাতন ধর্মালম্বীদের। এমন পরিস্থিতিতে ফকিরহাট উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দান করেন। তবে কতটুকু জমি দিয়েছেন তা জানাতে রাজি হননি তিনি।

মসজিদের জন্য জমিদাতা সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ বলেন, আমরা হিন্দু-মুসলমান পরস্পর সহমর্মিতা নিয়ে বসবাস করি। আমাদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি। এখানে মুসলমান ভাইদের জন্য মসজিদ ছিল না। তখন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলি। আমি প্রথমে অল্প কিছু জমি প্রদান করি। পরবর্তীতে এখানে নারীদের নামাজের স্থান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এখানে লিল্লাহ বোডিং করারও পরিকল্পনা মসজিদ কমিটির রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের এক মুসলমান ভাই শ্মশানের জন্য জমি দান করেছেন। আমি আশা করি আমাদের এই বন্ধন চিরঅটুট থাকবে।

শ্মশানের জন্য জমিদাতা শেখ মিজানুর রহমান বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমরা বড় হয়েছি। কয়েক বছর আগে ভৈরব নদ পুনঃখননের কারণে প্রায় ২০০ বছরের শ্মশানটি বিলীন হয়ে যায়। ফলে হিন্দু ভাই-বোনদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছিল। আমি অন্য ধর্মের লোক হলেও তাদের এই সমস্যা আমার অনুভূতিতে আঘাত করে। তখন নদের পাশে থাকা আমার জায়গা আমি শ্মশানের জন্য উৎসর্গ করি।

মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. গাউসুল আলম বলেন, আমাদের এই বিশ্বরোড এলাকায় কাছাকাছি মসজিদ না থাকায় আমাদের নামাজ পড়তে বেশ অসুবিধা হতো। পরবর্তীতে প্রণব বাবু নিজ উদ্যেগে নামমাত্র মূল্য নিয়ে মসজিদের জন্য জায়গা প্রদান করেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

হাঙ্গার প্রজেক্টের উপজেলা পিএফজি (পিস ফ্যাসিলেটেটর গ্রুপ) কমিটির সমন্বয়কারী মো. আরিফুল হক বলেন, ফকিরহাট উপজেলায় হিন্দু ধর্মের মানুষের মসজিদে এবং মুসলমানের শ্মশানের জন্য জমিদান সত্যিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। তাদের এই মহত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ২৩ এপ্রিল হাঙ্গার প্রজেক্টের মাধ্যমে সম্মাননা দেওয়া হয়।

ফকিরহাট আজাহার আলী কলেজের শিক্ষক আবুল আহসান টিটু বলেন, ভৈরব নদ পুনঃখননের ফলে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী শ্মশানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেসময় এখানে মরদেহ সৎকারের জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখন স্থানীয় শেখ মিজানুর রহমান শ্মশানের জন্য জায়গা দান করেন। অন্যদিকে একজন হিন্দু ধর্মালম্বী মসজিদের জন্য জায়গা দিয়েছেন। দুটি ঘটনাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত।

ফকিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার দাশ বলেন, শত শত বছর ধরে এ জনপদের হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন। একে অপরের সুখ-দুঃখে একাত্ম হয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও আমাদের এখানের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধন দেশের মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।