Home > অন্যান্য > চাকরিতে প্রবেশের বয়স স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি কেন নয়?

চাকরিতে প্রবেশের বয়স স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি কেন নয়?

হসানুল হক ফরিদপুর থেকে: ১৯৯১ সালে যখন গড় আয়ু ছিলো ৫৭ বছর তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করে ২৭ বছর থেকে ৩০ বছর এ উন্নীত করা হয়। গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে ৫৯ বছর এ উন্নীত করা হলেও প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর হলেও বিসিএস স্বাস্থ্য, জুডিশিয়াল ও বিদ্যমান কোটার ক্ষেত্রে ৩২ বছর। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৭ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭৩ বছর, কাজেই চাকরীতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সিট থাকায় সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের অনার্স কোর্সে ৭ বছর এবং মাস্টার্সে ১ বছরের কোর্সে প্রায় ২ বছর লাগে। ২০১৮ সালে ক্রাস প্রোগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট কমিয়ে আনার চেষ্টা করলেও ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে থুবড়ে পড় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।

তবে এই মুহূর্তে যাদের বয়স শেষ হয়েছ বা যাদের বয়স শেষের দিকে তাদের ক্ষতি অপূরণীয়। তারা উভয় দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। একদিকে একাডেমীক সেশনজট অপরদিকে করোনা মহামারী। করোনা মহামারীর আগে যাদের বয়স ২৮ বছর ছিলো এখন তাদের বয়স ৩০ বছর।

জাহিদ হাসান নামে এক চাকরীপ্রত্যাশী বলেন, আমরা সরকারের কাছে চাকরি চাই না শুধু চাকরিতে আবেদনের সুযোগ চাই অর্থাৎ প্রনেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি চাই , সম্প্রতি চাকরীর বয়স শেষ হওয়া অনেকেই আত্নহত্যার করবেন এমন হতাশাজনক পোস্ট বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপে দেখা যাচ্ছে।

এদিকে আওয়ামীলীগ সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিলো, পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তবতার নিরিখে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু দীর্ঘ দিন পার হলেও এ নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশাগ্রস্থ চাকরীপ্রত্যাশীরা।

মুজীব বর্ষের একটি অঙ্গীকার ছিলো এদেশের যুব প্রজন্মের জন্য আরও বেশি পরিমাণে কর্মসংস্থানের জন্য অনেক শূন্য পদের চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি যেখানে এখনও দেশে শূন্য পদ রয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ। করোনা মহামারীতে চাকরির আবেদনের বিজ্ঞপ্তি ৮৭% থেকে ১৩% এ নেমে এসেছে এবং দেশে বেকারত্বের হার ২০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৯% এ দাঁড়িয়েছে এবং বেকারদের অধীকাংশ উচ্চ শিক্ষিত।

সেশনজট ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত যুব প্রজন্ম দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। এ ধরনের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় দেশবাসী দেখছে বেকার যুবকদের হাহাকার।

করোনা পরিস্থিতির কারণে হত ১৭ মাস ব্যাকডেট বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা থাকলও উল্লেখ করার মত তেমন কোন বিজ্ঞপ্তি হয়নি। ডিসেম্বর ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যাকডেট বিজ্ঞপ্তির কথা থাকলেও ৪৪ বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি ও সেভাবে হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে এই বেকার মানুষগুলো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, কোভিডের ভয়াল থাবা অন্য সব সেক্টরের মানুষের মতো তাঁদেরও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

কারণ, বিগত ২০২০ সালের মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সব সরকারি চাকরির সার্কুলার ও একই সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়া। করোনা পরিস্থিতির জন্য গত দেড় বছরে হাতে গোনা কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়েছে যার অধিকাংশই আবার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য।

চাকরিপ্রত্যাশীদের মতে, একই দিনে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করায় তাঁরা কয়েকটি সেক্টরে তাঁদের ভাগ্য পরীক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে তাঁরা সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো, নিয়োগ-দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষার বিধান পরিবর্তন করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমগুলোতে এসব বিষয়ে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলন করে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। দেশের শীর্ষ তালিকার সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

মন্ত্রী পর্যায় থেকে অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁরা কেউ কোনো গঠনমূলক কথা তো দূরের কথা, কোনো আশ্বাসবাণীও শোনাননি। তাঁদের কারও কারও পরামর্শ ‘আপনারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন’। আমার প্রশ্ন, তাহলে অন্যরা বিভিন্ন অবস্থানে ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন কেন? তা ছাড়া সাধারণ নাগরিকের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো কি মুখের কথা?

এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র চাকরী পত্যাশী যুব প্রজন্মের সমন্বয়ক ওমর ফারুক বিডি২৪লাইভ কে বলেন, উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে এবং বাংলাদেশের বর্তমান কর্মক্ষম যুব সমাজকে কাজে লাগাতে বর্তমান সরকারের উচিত বয়সসীমার এই সংকট নিরসনে সার্বিকভাবে বিবেচনায় বয়সসীমা বৃদ্ধি করা। আজ আমরা যারা বয়স বৃদ্ধিসহ ৪ দফা দাবির কথা বলছি হয়তো কাল আমরা থাকবোনা কিন্তু এই দাবিতে কেউ না কেউ এসে দাঁড়াবে। তাই সরকারের প্রতি বিনীত আহবান থাকবে, আমাদের এই দাবী যেন খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করেন এবং এই সংকট নিরসন করেন।

চাকরী প্রত্যাশী যুব প্রজন্মের সমন্বয়ক রিগান মাহমুদ বিডি২৪লাইভ কে বলেন, একমাত্র পাকিস্তান বাদে পৃথিবীর কোন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩০ নাই। আমরা যদি উন্নয়নশীল দেশ হয়ে থাকি তাহলে পৃথিবীর কোন উন্নয়নশীল দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ আছে বলতে পারেন?

পৃথিবীর ১৬২ টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৫ এর উপরে, তাহলে আমাদের দেশে কেন আমরা ৩০ এ বন্দী থাকবো? দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে চাইলে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নাই। তাই বয়সের বেড়াজালে এই তরুণ প্রজন্মের মেধাকে ধ্বংস করে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেন না।

মুজিববর্ষের ওয়াদা ছিলো সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান করা হবে। সেই ওয়াদা রাখা হয়নি। ৪ লাখের মতো শূন্য পদ থাকলেও সেই শূন্য পদ পূরণ করা হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে শুনে আসছি ৪ লাখের কাছাকাছি শূন্য পদ রয়েছে , তাহলে কেন এই শূন্য পদের সার্কুলার দিয়ে বেকার সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না? বেসরকারি চাকরিতে ও বয়সসীমা ৩০ বছর, তবে সেখাও ২-৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় , যা সাধারণ ছাত্রদের জন্য বড় বাঁধা।

একাডেমিক শেষ করে হাতে থাকে ২-৩ বছর। তাই সবকিছু বিবেচনা করে বয়স বৃদ্ধি দরকার। এই করনোর মধ্যেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসামে বয়সসীমা বৃদ্ধি করে ৩৮ থেকে ৪০ বছর করা হয়েছে আবার কিছুদিন পূর্বে উড়িষ্যায় বয়সসীমা ৬ বছর বৃদ্ধি করে ৩৮ করা হয়েছে । তাহলে আমাদের দেশে কেন বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে না?

তিনি আরও বলেন, আজকে দীর্ঘ ১০ মাস ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে আমরা রাজপথের আন্দোলন করে আসছি। এর মধ্যে আমরা সব জায়গায় স্মারকলিপি দিয়েছি। কুটনৈতিক যোগাযোগ, মানববন্ধন, সমাবেশ, মহা সমাবেশ, মৌন সমাবেশ, প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছি৷ আমাদের এই যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আমরা যখন নীতিনির্ধারকদের কাছে গেছি তখন তারা এই দাবির জন্য জন সমার্থন দেখাতে বলছেন।

আমরা ১১ জুন, ২৭ আগষ্ট ও ৮ ডিসেম্বর ২০২১ এবং গত ১৬ জানুয়ারি ২০২২ আমরা চাকরি প্রত্যাশী যুব প্রজন্ম যখন রাজপথে জনসমার্থন দেখালাম তখন আমাদের পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হতে হলো। তাহলে নীতিনির্ধারকদের কাছে আমরা ছাত্র সমাজ জানতে চাই, আপনারা বলবেন রাজপথে জনসমার্থন দেখাতে, আবার রাজপথে নামলে ছাত্র সমাজের উপর পুলিশি লাঠি চার্জ করা হলো।

তাহলে আমরা সাধারণ ছাত্র সমাজ যাবো কোথায়? ১৬ জানুয়ারি আমরা সাধারণ ছাত্র সমাজ যখন রাজপথ নামলাম তখন আমাদের ১৩ জনকে মিরপুর-২ মডেল থানায় ও শাহবাগ থানায় ৩ জনকে, টোটাল ১৬ জনকে আটক করা হলো। একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে কথা বলতে গেলে কেন রাজপথে নেমে নির্যাতনের স্বীকার হতে হবে? তাই আমাদের আকুল আবেদন নীতিনির্ধারকদের কাছে দয়াকরে আমাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধিসহ ৪ দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করেন।

ঘন জনবসতির দেশ বাংলাদেশ, এ দেশের সার্বিক উন্নয়নে দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিনত করতে হবে। দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। কাজেই দেশের কল্যাণেই চাকরির বয়স বৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরী করে বেকার যুবকদের কাজে লাগাতে উচিৎ। সার্বিক বিবেচনায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধিতে দেশেই স্বার্থ নিহিত রয়েছে।