Home > জাতীয় > সারাদেশ > লঞ্চের প্রেম জলে, মেঘার ঠাঁই কবরে, মাহিবী কা’রাগারে!

লঞ্চের প্রেম জলে, মেঘার ঠাঁই কবরে, মাহিবী কা’রাগারে!

বরিশালের পথে চলছে এমভি সুন্দরবন লঞ্চ। লঞ্চের একটি কেবিন কক্ষে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী সায়মা কালাম মেঘা ও তাঁর প্রেমিক মাহিবী হাসান। পুরো কক্ষ লাল বেলুনে ভর্তি। চলছে কেক কাটা আর পার্টি স্প্রে ছিটিয়ে মাহিবীর জন্মদিন উদযাপন।

কেক কা’টা শেষ হতেই উচ্ছ্বসিত মেঘা প্রেমিক মাহিবীকে বলেন, ‘উইল ইউ ম্যারি মি?’ মাহিবীর উত্তর, ‘ইয়েস।’ এরপর মেঘা ‘কবুল’ বলতে বললে তিনবার কবুল বলেন মাহিবী। পরে জন্মদিনের উপহার হিসেবে প্রেমিকের আঙুলে আংটি পরিয়ে দেন মেঘা। এরপর চলে একজন আরেকজনকে খাইয়ে দেওয়া আর খুনসুটির গল্প। মেঘার মুঠোফোন দিয়ে করা ভিডিওতে এসব দৃশ্য দেখা যায়।

মেঘা ও মাহিবীর এ রকম লঞ্চযাত্রা ছিল নিয়মিত ঘ’টনা। মেঘার ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরা কিংবা গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার সময় দুজন একসঙ্গেই হতেন লঞ্চের যাত্রী। শুধু মেঘার জন্যই প্রায় সময় ঢাকায় আসতেন মাহিবী।

সায়মা কালাম মেঘার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার শ্ম’শানঘাট রোডে। ইডেন কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগে পড়তেন তিনি। মেঘার পাশের ভিআইপি রোডের বাসিন্দা মাহিবী হাসান। বরিশালের হাতেম আলী কলেজে লেখাপড়া করতেন তিনি। তাঁর বাবার নাম মৃ’ত নফিজুর রহমান।

ঝালকাঠিতে থাকাকালে ২০১৬ সালে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্প’র্ক গড়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স’ম্পর্ক আরো গভীর হয়। নিয়মিত কথা চলত মুঠোফোনে। একসময় মুঠোফোনের মাধ্যমে মজার ছলে বিয়েও করেন তাঁরা। সেই ফোন রেকর্ডিংয়ে প্রথমে মাহিবী বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদের মেয়ে সায়মা কালাম মেঘাকে ২০০১ টাকা দেনমোহর দিয়ে আমি মাহিবী হাসান বিবাহ করিলাম।’ এরপর তিনবার কবুল বলেন মাহিবী। একইভাবে সায়মা কালাম মেঘাও কবুল বলেন।

সায়মা কালাম মেঘা ২০১৭ সালে ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। এর পর থেকে মাহিবী প্রায়ই ঢাকায় যাওয়া-আসা করতেন। মেঘা থাকতেন রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায়। মাহিবী হাসান থাকতেন ঝালকাঠির নিজেদের বাড়িতে। মাহিবী ঢাকায় এলে দুজন একসঙ্গে কেনাকাটা করতেন। আত্মীয়স্বজনের বাসায় সময় কা’টাতেন। শেষে মেঘাকে নিয়ে লঞ্চের কেবিনে করে বরিশালের পথে রওনা হতেন।

একটা সময় মেঘা আর মাহিবীর এই স’ম্পর্কের কথা জেনে যায় দুজনের পরিবার। বিয়ের ব্যা’পারেও স’ম্মতি দেয় তারা। পরিবারের স’ম্মতিতে মে’লামেশা আরো বাড়তে থাকে তাঁদের। কিন্তু পরে মাহিবীর মা তাঁদের এ স’ম্পর্ক মেনে নিতে চাননি। তাই তাঁরা দুবার বিয়ের প্র’স্তুতি নিয়েও সম্পন্ন করতে পারেননি। বিয়ের প্রস্তু’তি হিসেবে কেনাকাটাও করেছিলেন মেঘা। বিয়ে উপলক্ষে চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেঘা তাঁর বন্ধুদের দাওয়াত দিলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময়মতো আসেননি মাহিবী।

এর পরে শুরু হয় মাহিবী আর মেঘার মধ্যে ঝগড়া। মেঘাকে অপমান ও কটু কথা বলে মা’নসিক নি’র্যাতন করতে থাকেন মাহিবী। একটা সময় মেঘাকে বলেন, ‘আমার বিদেশ যেতে ১০ লাখ টাকা লাগবে। তোমার বাবার কাছ থেকে এই টাকা এনে দেবে। না হলে তোমাকে আমার বিয়ে করা সম্ভব না।’ এই কথা মেঘা তাঁর মা রুবিনাকে জানালে তিনি গত ১৫ এপ্রিল মাহিবীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজনকে জানান।

পরে মাহিবীর মা ঝালকাঠির কীর্তিপাশা হাসপাতালের নার্স সেলিনা নফিজ কোনো শর্ত ছাড়াই ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হন। তবে প্রথমে রাজি হলেও পরে আবার মুখ ফিরিয়ে নেন মাহিবীর মা। এরপর মেঘাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন মাহিবী। এতে পুরোপুরি হ’তাশ হয়ে পড়েন মেঘা। বেছে নেন আ’ত্মহ’ত্যার পথ।

চলতি বছরের ২১ এপ্রিল, বিকেল। আ’ত্মহ’ত্যার আগে কাঁঠালবাগানের বাসায় বসে মেঘা নিজের হাত কেটে তা ভিডিওকলে মাহিবীকে দেখান। তবু বেঁ’চে থাকার উৎসাহ না পেয়ে কিছু সময় পর ঘরের ফ্যানের স’ঙ্গে গলায় ওড়না পেঁ’চিয়ে ঝু’লে পড়েন মেঘা। সেই দৃ’শ্যও মাহিবী হাসান দেখেন ভিডিওকলের মাধ্যমে। এ ঘ’টনা ঘ’টে বিকেল ৫টার দিকে। ৫টা ৯ মিনিটে মেঘার মা রুবিনা বেগমকে মুঠোফোনে এ ঘ’টনা জা’নান মাহিবী হাসান।

মৃ ত্যুর আগে লেখা মেঘার ‘সু’ইসাইড নোট’ আ’ত্ম’হ’ত্যার আগে মেঘা একটি লেখা লিখে তাঁর ব্যাগের ভেতরে রেখে যান। ওই সু’ইসাইড নোটে তিনি লিখেন, ‘আমি বাঁ’চতে চাইছিলাম, কিন্তু মাহিবী আর ওর মা আমারে বাঁ’চতে দেয় নাই। আমি মাহিবীর কাছে বারবার কু’ত্তার মতো যাই, আর ওর মা-বোন আমারে যা তা বলে। আব্বু-আম্মু আমারে মাফ কইরা দিও। আমার লাশের আশপাশেও যেন মাহিবী আসতে না পারে।’

সায়মা কলাম মেঘা ও মাহিবী হাসানের লঞ্চ ভ্রমণ, তাঁদের নানা সময়ের ছবি, প্রেমের টা’নাপোড়েন ও আ’ত্মহ’ত্যার সময়কালের কথোপকথন, অডিও-ভিডিও ও এ-সং’ক্রান্ত অন্য অনেক তথ্য এনটিভি অনলাইনের হাতে এসেছে। সেসব তথ্য-প্র’মাণের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন।

প্রথমে অপমৃ’ত্যু ও পরে আ’দালতে হ’ত্যা মা’মলা দা’য়ের ঘ’টনার দিন অনেক তথ্য-প্রমাণই মেঘার পরিবারের কাছে ছিল না। সে জন্য সেদিন মেঘার চাচা আবুল বাসার ঢাকা মহানগর পু’লিশের (ডিএমপি) কলাবাগান থা’নায় একটি অপমৃ’ত্যুর মা’মলা করেন। পরে সায়মা কালাম মেঘার মুঠোফোনের যাবতীয় তথ্য-প্রামাণ হাতে পায় তাঁর পরিবার। পরে মেঘার পরিবার মাহিবী হাসানের বি’রুদ্ধে কলাবাগান থা’নায় হ ত্যা মা’মলা করতে গেলে মা’মলা নেওয়া হয়নি। থা’না থেকে মেঘার পরিবারকে বলা হয়, ‘ময়’নাতদ’ন্তের প্র’তিবেদন না পেলে হ ত্যা মা’মলা নেওয়া স’ম্ভব না।’ এসব কথা এনটিভি অনলাইনকে জা’নান মেঘার মা রুবিনা বেগম।

রুবিনা বেগম বলেন, ‘পরে দুই মাস ঢাকা মেডিকেলে ঘু’রেছি। কিন্তু ময়’নাতদ’ন্তের রি’পোর্ট পাইনি।’

এরপর ২ জুলাই ঢাকার নারী ও শি’শু নির্যা’তন দ’মন ট্রা’ইব্যুনালে মা’মলা করা হয়। মা’মলায় আ’সামি করা হয় মাহিবী হাসান (২৫), তাঁর মা সেলিনা নফিজ (৫০), বোন নওরীন বন্যা (১৮) ও সুব্রত দাসের বি’রুদ্ধে (২৫)। এরপর মা’মলাটি পু’লিশ ব্যু’রো অব ইন’ভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হ’স্তান্তর করেন আ’দালত। ২০ সেপ্টেম্বর আ’দালতে মা’মলার অ’ভিযোগপত্র দা’খিল করে পিবিআই। সেখানে শুধু মাহিবীকে আ’সামি করে বাকি তিনজনকে অ’ব্যাহতি দিয়ে অ’ভিযোগপত্র দা’খিল করা হয়।

রুবিনা বেগম বলেন, ‘অ’থচ এ ঘ’টনায় মাহিবীর মা খুব ভালোভাবে জ’ড়িত। মাহিবীর মা আমার মেয়েকে বিভিন্ন সময় গা’লি দেন এবং মরে যেতে বলেন। সেসব প্রমাণও আমাদের কাছে আছে।’

গ্রে’প্তারি প’রোয়ানা জা’রি করা হলেও গ্রে’প্তার হয়নি আ’সামিরা রুবিনা বেগম আরো বলেন, ‘এরপর ২২ সেপ্টেম্বর মাহিবীর মা আমাদের বিরুদ্ধে জিডি করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর আমি পিবিআইর দেওয়া রিপো’র্টের বি’রুদ্ধে আ’দালতে পি’টিশন করি। কারণ, মাহিবীর মা আমার মেয়ে হ ত্যার প্র’রোচনা দেওয়ার জন্য জ’ড়িত, সেই প্র’মাণ আমার কাছে ছিল। দুদিন পর বিচা’রক আবার পিবিআইর দেওয়া প্র’তিবেদনের বিরু’দ্ধে গিয়ে মাহিবী, তাঁর মা ও বোনের বি’রুদ্ধে গ্রে’প্তারি প’রোয়ানা জা’রি করেন।’

মেঘার মা বলেন, ‘৩ অক্টোবর সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আমাদের ঝালকাঠি থা’নায় পাঠি’য়ে দেন আ’দালত। কিন্তু কাউকেই গ্রে’প্তার করেনি পু’লিশ। পু’লিশকে বারবার জা’নানো হলেও তারা কোনো ব্য’বস্থা নেয়নি। মাহিবীর এক আ’ত্মীয় আছেন, যিনি পু’লিশ। তিনি যোগাযোগ আর টাকা-পয়সা দিয়ে পু’লিশকে সামাল দিয়েছেন। এবং ভেতরে ভেতরে আমাদের সঙ্গে সমঝো’তার চেষ্টা করেছেন।’

মাহিবী এখন কা’রাগারে ঝা’লকাঠিতে মেঘার পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টার একপ’র্যায়ে গত ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এসে আ’ত্মসম’র্পণ করে জা’মিন আবেদন করেন মাহিবী, তাঁর মা সেলিনা নফিজ ও বোন নওরিন বন্যা। তখন আ’দালত মাহিবী হাসানকে গ্রে’প্তার দেখিয়ে কা’রাগারে পা’ঠান এবং তাঁর মা ও বোনকে জা’মিন দেন।

জা’মিন পেয়ে মেঘার পরিবারকে হু’মকি-মা’মলা ২৬ নভেম্বর জা’মিন পাওয়ার পর মাহিবীর মা ও বোন মেঘার পরিবারকে হু’মকি দিতে থাকেন। এতে আ’তঙ্কিত হয়ে পড়ে মেঘার পরিবার। এমনকি মেঘার বাবা ও ভাইকে মা’দক মা’মলায় ফাঁ’সিয়ে দেওয়ার হু’মকিও দেওয়া হয়। মাহিবীর মা সেলিনা নফিজ তাঁর লোকজন দিয়ে এ হু’মকি দে’ওয়াচ্ছেন বলে রুবিনা বেগমের দা’বি। গত সোমবার ঝালকাঠি নির্বা’হী ম্যাজি’স্ট্রেট আদা’লতে ১০৭ ধা’রায় একটি হু’মকির মা’মলা করেছেন মেঘার বাবা আবুল কালাম আজাদ। সুত্র: এনটিভি