কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন কোনো একটি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলছেন। সামাজিক মাধ্যমের সূত্র ধরে গণমাধ্যমেও এসেছে বিষয়টি।
সেখানে বলা হয়েছে, এটি সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে রিসোর্টের একটি ক্যাসিনো এবং বেশ পুরোনো। অনেকেই আমার ইনবক্সে ভিডিওটি পাঠিয়ে এ বিষয়ে লেখার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু একজন মানুষ বিদেশে বৈধ ক্যাসিনোতে সময় কাটাচ্ছেন, এতে লেখার কী আছে, আমার মাথায় ঢোকেনি।
ক্যাসিনো বাংলাদেশে বেআইনি হলেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তা বৈধ। একজন মানুষ তার বৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে কালেভদ্রে ক্যাসিনোতে গেলে আমার কোনো আপত্তি নেই। বছর দশেক আগে একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। ঐ একবারই যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যাওয়ার আগেই পরিকল্পনা ছিল অন্তত একরাত লাসভেগাসে দেখে আসবো। ব্যস্ততার কারণে সে সুযোগ হয়নি বটে।
তবে ফিরে আসার আগের রাতটা কাটিয়েছিলাম আটলান্টিক সিটিতে। লাভেগাসের মত আটলান্টিক সিটিও জুয়ার শহর। তবে লাসভেগাসের মত অত বড় নয় নাকি। সে রাতে আটলান্টিক সিটির ক্যাসিনোতে ব্যয় করার জন্য আমার বাজেট ছিল ১০০ ডলার। এটা ছিল নিছক ফান। ক্যাসিনো বৈধ, এমন কোনো শহরে আবার যাওয়ার সুযোগ হলে, সময়ের সাথে মিললে আমি আবারও ক্যাসিনোতে যেতে পারি।
তবে বাংলাদেশে ক্যাসিনো বেআইনি। জুয়া খেলাও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় জুয়া খেলাটা পাপ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বিষয়টা যতটা না আইনি, তারচেয়ে বেশি সামাজিক নৈতিকতার। যেমন বাংলাদেশে যে ক্যাসিনো অবৈধ এবং এত ঘৃণার বিষয়, তাও কিন্তু আইনে আটকানোর খুব বেশি সুযোগ নেই।
এই যে সরকারের সাম্প্রতিক অভিযানে ক্যাসিনো চালানোর দায়ে অনেক রাঘব বোয়াল ধরা পড়েছেন; তাদের বিরুদ্ধে মাদক, অর্থ পাচার, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে মামলা হয়েছে; ক্যাসিনোর ঘটনায় কিন্তু কোনো মামলা হয়নি। অভিযানের সময় ক্যাসিনো খেলার সময় যারা হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও কিন্তু কোনো মামলা হয়নি। সম্ভবত সবাই মুক্তি পেয়ে গেছেন। তারপরও ক্যাসিনোতে যাওয়া বা জুয়া খেলা বাংলাদেশে অগ্রহণযোগ্য। আমি কাউকে ক্যাসিনোতে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছি না। আবার কেউ গেলে আমি বাধাও দেবো না বা ছি ছিও করবো না।
কখনো কখনো আইনি বাধ্যবাধকতার চেয়ে সামাজিক নৈতিকতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটা আবার ব্যক্তিভেদে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তবে আমার ক্যাসিনোতে যাওয়া আর পাপনের ক্যাসিনোতে যাওয়া এক নয়। আবার পাপনের ক্যাসিনোতে যাওয়া আর সুজনের ক্যাসিনোতে যাওয়াও এক নয়। আবার সুজনের ক্যাসিনোতে যাওয়া আর কোনো ক্রিকেটারের ক্যাসিনোতে যাওয়া এক নয়। পাপনের ক্যাসিনোতে যাওয়া আমার কাছে অত সিরিয়াস মনে না হলেও সুজনের যাওয়া (আদৌ গিয়েছেন কিনা জানি না, কারণ তিনি সাক্ষাৎকারে অস্বীকার করেছেন) নিয়ে প্রবল আপত্তি ছিল।
খালেদ মাহমুদ সুজন যখন দলের সঙ্গে ম্যানেজার বা ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে ভ্রমণ করেন; তখন তাকেও ক্রিকেটারদের সমান শৃঙ্খলা ও নিয়ম মেনে চলতে হবে। তবে সুজন যদি ব্যক্তিগত সফরে গিয়ে ক্যাসিনোতে যান, আমার আপত্তি থাকবে না। আর অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটারদের কোনো সময়েই ক্যাসিনোতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ক্রিকেটাররা আমাদের আইডল। তারা যা করেন, কোটি মানুষ তা দেখবে, প্রভাবিত হবে, কোটি শিশু তাদের মত হতে চাইবে। তাই তাদেরকে থাকতে হবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
নাজমুল হাসান পাপনের ক্যাসিনোতে যাওয়া নিয়ে আমার আপত্তি নেই বটে, তবে তিনি না গেলে ভালো করতেন। কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিরও নৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন থাকা সঙ্গত।
যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা- বলে একটা কথা আছে। মনে হচ্ছে নাজমুল হাসান পাপন সেই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। সাকিব আল হাসান ইস্যুতে দুটি পক্ষ- আইসিসি আর সাকিব আল হাসান। এখানে বিসিবি কোনো পক্ষ নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এটা বিসিবির জানার সুযোগও ছিল না। শাস্তির পর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সাকিব আল হাসান লিখেছেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আইসিসি আকসুর পুরো তদন্তটাই ছিলো অত্যন্ত গোপনীয় এবং আমার ওপর শাস্তি আরোপিত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে বিসিবিকে আমি এ ব্যাপারে জানাই।
দেরিতে জানলেও এমন পরিস্থিতিতে বিসিবিই আমাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছে। তাই, বোর্ডের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ সাকিব আল হাসান পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করলেও গোটা জাতি সাকিবের শাস্তির জন্য পাপনকে দায়ী ভাবছে। যেন ২১ অক্টোবর সাকিব ক্রিকেটারদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পর পাপন আইসিসিকে বলে ২৯ অক্টোবর শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। সাকিবের ঘটনায় পাপনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বা থাকা সম্ভব নয়। তবুও সবাই তাকেই অপরাধী ভাবছে। তার পদত্যাগ চাইছে।
পাপনের ক্যাসিনোতে যাওয়ায় আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি বিশ্বাস করি সাকিবের ঘটনায় তার কোনো দায় নেই। তবুও আমি মনে করি নাজমুল হাসান পাপনের সরে যাওয়া উচিত। সত্যের চেয়ে ধারণা কখনো কখনো শক্তিশালী। আর পাপন সম্পর্কে এখন জনপ্রিয় ধারণা হলো, তিনি ক্রিকেটের শত্রু, ক্রিকেটের প্রতিবন্ধকতা।
জনগণের আবেগকে সম্মান জানানোর জন্য দোষ না থাকলেও তার পদত্যাগ করা উচিত। তবে আমার ধারণা, ১১ দফা দাবিতে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পরদিন মানে ২২ অক্টোবর প্রতিক্রিয়া জানাতে তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাতেই নিজের পায়ে নিজে কুড়ালটা মেরেছেন নাজমুল হাসান পাপন। আসলে রেগে গিয়েই হেরে গেছেন তিনি। প্রতিক্রিয়ায় তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মানুষ পছন্দ করেনি। তাছাড়া তিনি ক্রিকেটারদের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের যে গল্পগুলো প্রকাশ্যে বলেছেন, তাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
প্রথম কথা হলো, ক্রিকেটারদের ক্রিকেট বহির্ভূত ফ্যাসিলিটিজ দেখা বোর্ড সভাপতির কাজ নয়। তবুও ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে তিনি যা করেছেন, তা গোপনই থাকা উচিত ছিল। ব্রেকআপ হয়ে গেলে ছেলেপেলে যেমন স্ক্রিনশট ফাঁস করে দেয়, পাপনের বিষয়টা তেমন ছেলেমানুষিই মনে হয়েছে। তাছাড়া পাপন যখন গর্ব করে বলেন, এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে মাশরাফি-তামিমের কথায় তাদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি বা সাকিবকে বোনাস দিয়ে দিয়েছি; তখন বোঝা যায় বাংলাদেশে ক্রিকেট অর্থ উপার্জনে অনেক আগালেও পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারেনি। যে কাজগুলো পাপন একাই করে ফেলেছেন, সেগুলো তো বোর্ডের সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা। পাপনের কথা শুনে মনে হয়েছে, বিসিবি তার পৈতৃক জমিদারি এবং তার কথাই সেখানে আইন। যারা বিসিবির খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, এটাই সত্যি।
অথচ বাংলাদেশের একটি খ্যাতিমান রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান নাজমুল হাসান পাপন একজন সত্যিকারের পেশাদার মানুষ। বিসিবির সভাপতি হওয়ার আগে থেকেই তিনি দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মার প্রধান নির্বাহী। এমন একজন কর্পোরেট জায়ান্টের হাত ধরে বিসিবিরও কর্পোরেট পথে যাত্রা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং পাপন বিসিবিতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য কায়েম করেছেন। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সেখানে আইন। কাগজে-কলমে পাপন বিসিবির সভাপতি। কিন্তু প্রায়শ তিনি সুপার সিলেক্টরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কে কোথায় খেলবেন না খেলবেন; সে সিদ্ধান্তও তিনিই দেন।
ব্যক্তিগতভাবে পাপনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ নেই বটে, তবে বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে নানা গুঞ্জন বাতাসে। আর্থিক মাপকাঠিতে বিসিবি বিশ্বের ক্রিকেট বোর্ডগুলোর মধ্যে তৃতীয়। প্রতিবছর শত কোটির হাতবদল হয় এখানে। অভিযোগ রয়েছে, বোর্ডের পরিচালকরাই নামে-বেনামে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সব কাজ করেন। বোর্ড পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারেনি বলেই, বেক্সিমকো ফার্মায় পাপনের ব্যক্তিগত কর্মচারী ইসমাইল হায়দার মল্লিক, ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে যার কোনো পরিচিতি নেই, হয়ে ওঠেন বিসিবির সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক।
আসলে এই মল্লিকই এখন বোর্ড চালান, তিনিই বিকল্প সভাপতি। ফিন্যান্স কমিটির সভাপতি হিসেবে পুরো লেনদেনে তার নিয়ন্ত্রণে। আরো একাধিক কমিটির সদস্য তিনি। আর চালান আসলে সব কমিটিই। অথচ এই বোর্ডেই আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির মতো নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠক চেয়েও কোনো দায়িত্ব পান না। নিছক নির্বাচিত হয়েছেন বলেই এখনও বোর্ডে বসার সুযোগ পান বটে। কোনো কাজেই তাকে ডাকা হয় না, এমনকি ক্রিকেটারদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সাকিবের শাস্তি পর্যন্ত এত বড় টালমাটালেও ডাক পাননি ববি।
অথচ বিএনপি সমর্থিত পরিচালকরা আছেন বহাল তবিয়তেই। নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেট বোর্ডে রাজনীতিকরণ করেননি, এটা তার প্রশংসা হতে পারতো। কিন্তু লোকমান হোসেন ভুইয়ার মত লোক, যিনি কিনা মোহামেডানের মত ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে ক্যাসিনোর ফাঁদে ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছেন, বরাবরই পাপনের আনুকূল্য পান। আরাফাত রহমান কোকোর ঘনিষ্ঠ, এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদার শ্যালক হানিফ ভুইয়াও বিসিবির গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই পাপন তাদের আগলে রেখেছেন। বিদেশী কোচরা বিসিবিতে যতটা সম্মান, মর্যাদা, অর্থ পান; দেশি কোচরা ততটাই অবহেলিত। সারওয়ার ইমরান বা নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মত কোচরা বিসিবিতে টিকতে পারেননি।
আরেকটা বিষয়ে নাজমুল হাসান পাপনের ভূমিকা ক্রিকেটের বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে আছে। পাপন যেন শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় দলের সভাপতি। জাতীয় দল যেখানে যায়, সেখানেই পারিষদসহ উড়ে যান পাপন। তাই সবসময় তাকে টিভিতে দেখা যায়, সক্রিয় মনে হয়। কিন্তু জাতীয় দলের বাইরে তার নজর নেই বললেই চলে। পাপন কি কোনোদিন কোনো জাতীয় লীগের ম্যাচ দেখতে ঢাকার বাইরে কোথাও গিয়েছেন, নিদেনপক্ষে বিকেএসপিতে গিয়েছেন? তাহলে তিনি পাইপলাইনের খেলোয়াড়দের চিনবেন কীভাবে? পঞ্চপাণ্ডবে ভর করে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য পেয়েছে বটে। কিন্তু তাদের পরে কারা দলের হাল ধরবে? ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সময় পাল্টাপাল্টি অভিযোগে অনেক তিক্ত সত্য বেরিয়ে আসে।
ক্রিকেটারদের আইনজীবী বলেছিলেন, বিদেশে গেলে ক্রিকেটাররা প্রতিদিন পান ৫০ ডলার আর পরিচালকরা পান ৫০০ ডলার। এখন পর্যন্ত কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। তার মানে অবিশ্বাস্য হলেও এটি সত্যি। তাহলে ক্রিকেট বোর্ড কি ক্রিকেটারদের জন্য না পরিচালকদের জন্য? সুযোগ-সুবিধা, বেতনের জন্য ক্রিকেটারদের আন্দোলন করতে হয়; আর পরিচালকরা চলেন হেলিকপ্টারে রাজকীয় হালে। বিদেশে গেলেও তারা সর্বোচ্চ সুবিধা নেন। ক্রিকেট বোর্ডকে ক্রিকেটারদের আস্থায় আনতে না পারা পাপনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
নাজমুল হাসান পাপনের আরেকটি বড় ব্যর্থতা হলো প্রতিভাকে ধারণ করতে না পারা। পাপনের আমলেই বাংলাদেশের দুই মহাতারকা মোহাম্মদ আশরাফুল এবং সাকিব আল হাসানকে নিষিদ্ধ হতে হয়েছে। তার মানে বিসিবি ক্রিকেটারদের যথেষ্ট মটিভেট করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাভাবিক হলো, বোর্ডের নিয়ম মেনে চলবেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু অনেকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল বোর্ড আসলে কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারের হাতে জিম্মি। হাতুরাসিঙ্গে অনেক কড়া কোচ ছিলেন, শৃঙ্খলার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। তাই সিনিয়র ক্রিকেটাররা তাকে চাননি। বোর্ডও তাদের কথা মেনে নিয়েছে। ক্রিকেটে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দুটি প্রয়োগেই ব্যর্থ হয়েছে বিসিবি। সুযোগ পেলে সব ছাত্রই ফাঁকি দিতে চাইবে। কড়া মাস্টার কোনো ছাত্রেরই পছন্দ নয়। ছাত্রের কথায় শিক্ষক বদলে ফেলা কোনো কাজের কথা নয়।
সাকিব বরাবরই বোর্ডকে পাত্তা না দিয়ে চলে আসছেন। একাধিকবার চেষ্টা করেও বোর্ড তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বিশ্বকাপের আগে অফিশিয়াল ফটোসেশনে সাকিবের না থাকা প্রসঙ্গে বোর্ড সভাপতির কণ্ঠে ছিল অসহায়ত্ব। তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ব্যবস্থা মানে যে সব সময় শাস্তিই হতে হবে এমন নয়। বোর্ড তাকে আস্থায় নিয়ে, ভালোবেসে, খেলোয়াড় হিসেবে তার গুরুত্ব ও প্রভাবের কথা বুঝিয়েও সাকিবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। সেই চেষ্টা করেছেন কিনা আমরা জানি না। করলেও সেটা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সাকিবের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। সমর্থককে পেটানো, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, দেশের হয়ে না খেলার হুমকি- সাকিবের সাফল্যের তালিকা যেমন লম্বা, অপকর্মের তালিকাও কম লম্বা নয়। ধীরে ধীরে সাকিব আসলে নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছিলেন, যার কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা মানতে হয় না। এই ড্যাম কেয়ার প্রবণতা থেকেই হয়তো একসময় জড়িয়ে গেছেন অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে।
বোর্ডের আরেকটি বড় ব্যর্থতা ঘরোয়া ক্রিকেটকে পাতানো ম্যাচের কালো থাবা থেকে মুক্ত করতে না পারা। প্রিমিয়ার লীগে না হলেও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে অধিকাংশ ম্যাচের রেজাল্ট আগে থেকেই ঠিক করা থাকে, এটা ক্রিকেট বোর্ডের দেয়ালও জানে। কোন দল উঠবে, কোন দল নামবে সেটা ঠিক করা হয় আসলে ভোটের হিসেবে। মাঠের খেলা হয় অভিনয়, রেজাল্ট আগেই ঠিক করা। ঘরোয়া ক্রিকেটে অবাধে পাতানো ম্যাচ খেলা কেউ যখন জাতীয় দলের সুযোগ পাবে, তখনও তার কাছে ম্যাচ পাতানোকে ডালভাতই মনে হবে। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচ জিরোতে নামিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে আবারও আশরাফুল বা সাকিবের মত কেউ না কেউ আমাদের মাখা হেঁট করবে।
আ হ ম মোস্তফা কামাল আইসিসিতে চলে যাওয়ার পর ২০১২ সালে বিসিবির দায়িত্বেআসেন নাজমুল হাসান পাপন। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছেন। দুই দফায় ইতিমধ্যে তিনি ৭ বছর বোর্ডের সর্বেসর্বা আছেন। এই দীর্ঘ মেয়াদে বোর্ডে একধরনের ক্লান্তি ভর করেছে। বর্তমান বোর্ডের মেয়াদ আরো ৩ বছর আছে। পাপন যেহেতু নির্বাচিত, তাই তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে, তাকে সরানোর সুযোগ নেই। তবে এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশে চায়ের দাওয়াত দেয়ার রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে একটা নির্বাচন হয় বটে, তবে আসলে বোর্ড প্রধান পদটি রাজনৈতিক। সরকার যাকে পছন্দ করে তিনিই নির্বাচিত হন।
তাই নির্বাচনের দোহাই দিয়ে এই বোর্ডকে আর টেনে নেয়ার কোনো মানে হয় না।
সাকিব ইস্যুতে ভিলেন হলেও, এ ব্যাপারে পাপনের কোনো দায় নেই। তবুও সাধারণভাবে তার জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ক্রিকেটারদের আস্থাও তিনি হারিয়েছেন। তাই নাজমুল হাসান পাপনের বোধহয় বিদায় বলার সময় এসেছে।
তার বাবা জিল্লুর রহমান, মা আইভী রহমানকে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা করে। সেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার উত্তরসূরি নাজমুল হাসান পাপনও যেন ভালোবাসা নিয়েই বিদায় নিতে পারেন। মানুষের ঘৃণা নিয়ে যাওয়ার চেয়ে, ভালোয় ভালোয় চলে যাওয়াটাই মঙ্গল। এই সুযোগও অনেকে পান না। পাপনের সামনে সুযোগ এসেছে, সম্মানজনক বিদায় নিশ্চিত করার।
আমি জানি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান অত্যন্ত সম্মানজনক, লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পদ। কেউই এই পদ স্বেচ্ছায় ছাড়তে চাইবেন না। কিন্তু কখনো কখনো সময়মত বিদায় বলতে পারাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ