Home > জাতীয় > খুলনা এসেন্সিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্টে বার্ষিক পিকনিকের নামে হরিলুটের অভিযোগ!

খুলনা এসেন্সিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্টে বার্ষিক পিকনিকের নামে হরিলুটের অভিযোগ!

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

খুলনা এসেন্সিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্টে (কেইএলপি) বার্ষিক পিকনিক আয়োজনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীদের মতে, পিকনিকের মোট বাজেট ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭০ টাকার মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই দুর্নীতির মূল হোতা হিসেবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাপলা খাতুন এবং তার সহযোগী মিজানুর রহমান (সহকারী কর্মকর্তা, প্রশাসন) কে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও, হিসাব বিভাগের প্রধান কাজী তানজিমা তাবাসসুমের বিরুদ্ধে এই অর্থ আত্মসাতের বৈধতা দেওয়ার এবং ব্যক্তিগত দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।

পিকনিকের নামে দুর্নীতির অভিযোগের বিস্তারিত

অভিযোগ অনুযায়ী, কেইএলপি-তে কর্মরত ৮৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য আয়োজিত এই পিকনিকের পুরো বাজেট, ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭০ টাকা, আগাম হিসেবে শাপলা খাতুন তার নিজ নামে তুলে নেন। খরচের ভাউচারগুলো পর্যালোচনা করে বেশ কিছু গুরুতর অসঙ্গতি পাওয়া গেছে:

জালিয়াতির প্রমাণ

পুরো বনভোজনের ব্যয় ভাউচারে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির হাতের লেখা বিদ্যমান। মুদি মাল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, কাপড়, ফলমূল ও অন্যান্য দোকানের ভাউচার একই ব্যক্তির তৈরি করা, যা দেখে বোঝা যায় যে, শাপলা খাতুন ও মিজানুর রহমান তাদের নিজেদের হাতেই খরচের হিসাব তৈরি করেছেন।

সকালের নাস্তায় প্রতারণা: সকালের নাস্তার ভাউচারে ১৬০ কেজি আপেল দেখিয়ে সেগুলো বিতরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একই ভাউচারে ১৫০ কেজি কমলা কেনার কথা উল্লেখ থাকলেও, তা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিতরণ করা হয়নি। অভিযোগ, এই ১৫০ কেজি কমলা শুধু কাগজ-কলমেই কেনা হয়েছে, বাস্তবে নয়।

চকলেট কেলেঙ্কারি

৮৮১ জন কর্মচারীর জন্য ২ টাকা দামের চকলেট কেনা হলেও (মোট ১৭৬২ টাকা), ভাউচারে ৪,০০০ পিস চকলেট ১০ টাকা দরে ক্রয় দেখিয়ে ৪০,০০০ টাকা বিল দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ৩৮,০০০ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

প্রধান অতিথির আপ্যায়নে বিশাল ব্যয়

পিকনিকে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সামাদ মৃধা। তার আপ্যায়নের জন্য ৪০ কেজি খাসির কলিজা ক্রয়ের ভাউচার তৈরি করা হয়, যার মূল্য দেখানো হয় ৪০,০০০ টাকা। এছাড়াও ৪০ কেজি আপেলের জুস ও আধামণ আঙুর ফল ক্রয়ের বিল দেখানো হয়। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, তার আপ্যায়নের জন্য রুপচাঁদা-৬০ কেজি, চিংড়ি-১১৫ কেজি, বোয়াল-৩৬ কেজি সহ ৭ প্রকারের মোট ২৬৪ কেজি মাছ ক্রয়ের বিল ৪,১৬,৫০০ টাকা দেখানো হয়। অথচ কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী ওই দিন কোনো মাছ চোখেই দেখেনি। অভিযোগ, এই বিশাল অঙ্কের টাকার সিংহভাগই মাছ ক্রয়ের দায়িত্বে থাকা সহ: প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানের পকেটে গেছে।

বিতর্কিত মডেলের জন্য ব্যয়

বনভোজনে মডেল মেঘনা আলমকে আনার কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ অনুষ্ঠানে তার কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। অথচ তাকে বনভোজনের রাতে খুলনা হোটেল সিটি ইনে রাখা বাবদ ৩০,০০০ টাকার বিল দেখানো হয়।

ব্রয়লার মুরগির নামে অর্থ আত্মসাৎ

২০০ কেজি ব্রয়লার মুরগি কেনা হয়েছে বলে ভাউচারে ৪২,০০০ টাকা দেখানো হয়েছে, যা কেউ চোখেই দেখেনি।

কোল্ড ড্রিঙ্কস ও পানির বোতলে কারচুপি

সবাইকে ২৫০ এমএল-এর কোল্ড ড্রিঙ্কস দেওয়া হলেও ৫০০ এমএল-এর বিল করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রত্যেকের জন্য ৩টি করে পানির বোতল বরাদ্দ থাকলেও মোট ৫,২০০ পিস বোতলের ভুয়া বিল দেখানো হয়েছে।

‘বেডশীট ব্যবসা’ ও কমিটি

৮৮১ জনের বনভোজন তত্ত্বাবধানের জন্য ৩০০ জনের কমিটি এবং অতিরিক্ত ১৫০ জন ক্যাটারিং কর্মী নিয়োগ করা হয়। প্রত্যেক কমিটি সদস্যকে উপহার হিসেবে একটি করে বেডশীট দেওয়া হয়, যার প্রকৃত মূল্য ৪৫০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা। কিন্তু ভাউচারে ‘ভিআইপি বেডশীট’ নামে একেকটি বেডশীটের মূল্য সর্বনিম্ন ১,৭০০ টাকা থেকে ৩,৭০০ টাকা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

সিগারেট বিলের নামে দুর্নীতি: সাধারণ এই বনভোজনে ৩,০৫,০০০ টাকার সিগারেট বিল দেখানো হয়, যার সিংহভাগই ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে সিবিএ নেতা ড্রাইভার কামাল ও তার সহযোগী আলামিন হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ।

হিসাব বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাপলা খাতুন ও সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের তৈরি করা এই ভুয়া বিল ভাউচারগুলো মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পেয়ে পাস করিয়েছেন হিসাব বিভাগের প্রধান কাজী তানজিমা তাবাসসুম (উপ-ব্যবস্থাপক, হিসাব)। তাকে কেইএলপি-র ‘ভয়ংকর নারী’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, যার ক্ষমতার কাছে সবকিছু তুচ্ছ।

তাবাসসুমের বিরুদ্ধে তার সহযোগী মাহবুব আলম (হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা) কে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থ দিয়ে অনৈতিকভাবে সুদের কারবার চালানোর অভিযোগও রয়েছে, যা প্ল্যান্টের সবাই জানেন। প্রাক্তন প্ল্যান্ট প্রধান এস এম আহসান রেজা একবার এই বিষয়টি হাতেনাতে ধরেছিলেন, কিন্তু তাবাসসুম সেবার পার পেয়ে যান। তবে রেজা সাহেবের বদলির পর তাবাসসুম তার কার্যক্রম আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এই দুর্নীতির অর্থে তিনি খুলনা মৌরি আবাসিকে প্লট, ৪৮ লক্ষ টাকা দামের গাড়ি এবং খুলনা নিউ মার্কেট এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন।

অভিযোগকারীরা বলছেন, হিসাব বিভাগের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তানজিমা তাবাসসুম হিসাবের কোনো কার্যক্রম বোঝেন না, শুধু বোঝেন কিভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থ দিয়ে সুদ ব্যবসা এবং দুর্নীতির অর্থের ভাগ নিয়ে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ কামানো যায়।

আওয়ামী লীগের আমলে তাবাসসুম ও তার স্বামী একসাথে ইডিসিএল-এ সরাসরি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান, যা এই প্রতিষ্ঠানে বিরল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাবাসসুম উপ-ব্যবস্থাপকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেন। অভিযোগ, কট্টর আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখেনি এবং বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন তাবাসসুম। শেখ সেলিমকে দিয়ে নিয়োগ পাওয়া তাবাসসুমের দাপট এখনো প্রতিষ্ঠানজুড়ে রয়েছে। ৫ই আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী সংসদ সদস্য মাহবুবুল আলম হানিফের দাপটও দেখাতেন তিনি। তিনি এখনো নিজ মুখেই বলে বেড়ান যে, তাকে কেউ কিচ্ছু করার ক্ষমতা রাখে না, যেখানে যা দরকার তা দিয়ে তিনি ম্যানেজ করে নেবেন।