শ্বাসরুদ্ধকর একটি দিন পার করলেন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দারা। তবে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ উপকূলীয় জেলার বিভিন্নস্থানে গাছপালা-ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এরমধ্যে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে প্রায় আড়াই হাজার, সেন্টমার্টিন ১২ শ ও বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ঘর ভেঙে গেছে। সচেতনতামূলক নানা উদ্যোগ এবং স্থানীয় লোকজন সচেতন থাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’য় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবের পর কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট মেরামত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু হয়েছে। আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। সকাল থেকে কক্সবাজারে বিমান চলাচলও শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোখার তাণ্ডবের পর রবিবার রাতেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন দুর্গত মানুষ। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমাটিন দ্বীপ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব। বাড়িঘর মেরামতের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তাদের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পও। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারিভাবে এখনও সহায়তা পাননি বলে দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।
কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, মোখার আঘাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৭৮টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৪৮টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যাম্পের ৩২ লার্নিং সেন্টার, একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ২৯টি মসজিদ ও মক্তব, ১৮৩টি টয়লেট, ৩২টি গোসলখানা, ২০টি নলকূপ, ১৩৫ ফুট রাস্তা, ৫৮টি অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোখার সময় ১২০টি স্থানে ভূমিধস, ২২৬টি গাছ উপড়ে পড়েছে বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ সময় সাত রোহিঙ্গা আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬১১ জন। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে ৫ হাজার ৩৮৬ জন রোহিঙ্গাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে সংস্থাটি।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম জানান, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়নের গাছের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে মোখা। এসব এলাকার ৩০ শতাংশ গাছ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বহু ঘর ভেঙে গেছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার আংশিক ও ২ হাজার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। শুধু সেন্টমার্টিনেই ১ হাজার ২০০ ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে। উপড়ে পড়েছে বহু গাছপালা। একইভাবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ঘর। তবে গাছ-পালা পড়ে কেউ হতাহত না হলেও মহেশখালীতে লবণের মাঠে লবণ সংগ্রহ করতে গিয়ে মারা গেছেন ৩ জন।
এর আগে রবিবার দুপুর থেকে প্রচণ্ড গতিতে বাতাস-বৃষ্টি বাড়তে থাকে, যার ফলে উপকূলের অনেক মানুষ ছুটে যায় আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। রবিবার বেলা ৩টার দিকে জাদিমুরা শিবিরের একাধিক রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে জানা গেছে, নারী ও শিশুদের আলাদা করে মসজিদ-মক্তবে রাখা হয়েছিলো। এসব ক্যাম্পে তিন শতাধিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা নুর বশর বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে দুপুরে প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টিতে অনেকের ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেকে ঘর রেখে স্বজনদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। শিবিরে প্রায় এক হাজার মানুষের ঘরের ক্ষতি হয়েছে।
উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. ইউনুছ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে আমার ক্যাম্পে ৫০০ ঘর ভেঙে গেছে। এ সময় গাছপালা পড়ে তিনজন আহত হন। আশ্রয়হীন মানুষকে জরুরি সহতায় দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় লবণের মাঠে কাজ করতে গিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালিতে তিন লবন চাষীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া মাঠে লবণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ জন লবণ চাষী এখনো ঘরে ফেরেনি জানা গেছে।
নিহতরা হলেন, উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজীর পাড়া গ্রামের আবুল ফজলের ছেলে রিদুয়ান (৩৫), পানিরছড়া গ্রামের আকতার কবিরের ছেলে মো. নেছার (৩২) এবং বারঘর পাড়ার মতনের ছেলে মো. আনছার (৩৬)।
হোয়ানক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর কাশেম চৌধুরী বলেন, ঘূর্নিঝড় মোখার সময় রবিবার বারঘর পাড়ার পশ্চিমের লবণের মাঠে কাজ করতে গিয়ে ঠান্ডা জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে বিকেলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছে। এছাড়া লবণ মাঠের পানিতে ভাসমান অস্থায় দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে লোকজন। এ ঘটনায় আরও হোয়ানকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আরও ১০ থেকে ১৫ জন লবণ চাষী এখনো ঘরে ফেরেনি বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
অন্যদিকে, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের ভয়ে কক্সবাজারের পেকুয়ায় শনিবার রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন প্রসূতি জয়নাব বেগম। এর পরই শুরু হয় তার প্রসববেদনা। কিন্তু আশেপাশে ছিল না কোনো গাড়ি। বিষয়টি জানতে পারেন পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর হায়দার দ্রুত নিজের গাড়ি নিয়ে প্রসূতিকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। সেখানে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন ওই গৃহবধূ। ওই নবজাতকের নাম রাখা হলো ‘মোখা’। এমন মানবিক কর্মকাণ্ডে প্রশংসাও কুড়িয়েছে ওসি।
ওসি ওমর হায়দার বলেন, কক্সবাজারে বিপদ সংকেত ঘোষণার পর এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে শুরু করি। রাতে রাজাখালী ইউনিয়নের এয়ার আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনে যাই। সেখানে গিয়ে খবর পাই এক গৃহবধূ প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছেন। দুর্যোগের রাতে আশেপাশে কোনো বাহন ছিল না। তখন নিজের গাড়িতে তুলে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। শুনে খুব আনন্দিত হয়েছি আমি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপদ সংকেত কেটে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন দুর্গত এলাকার মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ে যেসব বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সরকারিভাবে সহায়তা করা হবে।