সদ্য ঘোষিত ২৭৩০ প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির বিষয়ে নানা অসঙ্গতি নিয়ে সরব সোশ্যাল মিডিয়া। নতুন করে আলোচনায় কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলা সদর ইউনিয়নে এক/দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই চারটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়া নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমপিওভুক্ত হওয়া এই চারটি স্কুলের একই মালিকের দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার একটির পরিত্যক্ত ভবন, নেই কোনো শিক্ষার্থী।
প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
জরাজীর্ণ আর পরিত্যক্ত ভবনটি দীর্ঘ ৪/৫ বছর ধরে হাটের গরু রাখাসহ বর্তমানে মাদকাসক্তদের অপকর্মের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। নেই দরজা-জানালা, কক্ষগুলোতে রয়েছে গরুসহ খড়কুটা, গোবর ও জুয়া খেলার সরঞ্জামাদি। কাগজ-কলমে এ প্রতিষ্ঠানের জায়গা হলেও এর অস্তিত্ব মেলে অন্যত্র।
এমপিওর তালিকায় নাম আসার পরপরই রাতারাতি সোনাহাট ইউনিয়নের ঘুন্টির মোড় নামক স্থানে অন্য প্রতিষ্ঠান উপমা মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের ব্যানার লাগানো হয়েছে। টিনশেডের এ প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শিক্ষার্থী, বন্ধ পাঠদান কার্যক্রম। কাগজ-কলমে পরিচালনা হলেও পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তের তালিকায় কীভাবে গেল এ নিয়ে রয়েছে জনমনে প্রশ্ন।
অপরদিকে সদ্য এমপিওভুক্ত হওয়ায় ২৮ শতক জমিতে স্থাপিত এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটে চলছে পরীক্ষা। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান ছাড়া পায় না কোনো কারিগরি শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানে ল্যাবসহ কম্পিউটারের সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও এমপিও হয়েছে। কাগজ-কলমে স্থান ও শিক্ষার্থীদের নাম ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে চিত্র যেন ভিন্ন। এখানে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এনে পরীক্ষা দেয়া হয়। এফএ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর আগে পাসকৃত অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে দেখানো হয়। এমপিও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় থাকা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোদ্দাছেরুল ইসলাম স্বীকার করেন, প্রতিষ্ঠানের মূল জায়গা বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। আগে উপমা মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউট থাকলেও তাদের কোনো শিক্ষার্থী না থাকায় এটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এক বছর ধরে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় ২৬ শতক জমিতে গড়া এ টিনশেড ঘরেই এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
তার কথাতেও গড়মিল পাওয়া যায়। টিনশেড এ ঘরগুলোতে ক্লাস পরিচালনার জন্য পাওয়া যায়নি কোনো বেঞ্চ, বোর্ড কিংবা পাঠদানের সরঞ্জামাদি। যদিও অধ্যক্ষের দাবি ক্লাস হয় নিয়মিত। রয়েছে ১৯০ শিক্ষার্থী। আর শিক্ষক চারজন এবং স্টাফ ছয়জন। নিরাপত্তাজনিত কারণে এখানে কম্পিউটার ল্যাব না থাকলেও ১০টি কম্পিউটার রয়েছে। এফএ নামে একই মালিকের দুটি প্রতিষ্ঠান থাকায় অন্য প্রতিষ্ঠানে সেগুলো রয়েছে। তবে তার এ কথারও মিল পাওয়া যায়নি।
এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো ল্যাব কিংবা কম্পিউটার নেই। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত কোনো কারিগরি প্রশিক্ষণের ক্লাসই করেনি।
এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ আল-মামুনও ল্যাব-কম্পিউটার না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসা হচ্ছে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো অনুদান পাইনি এবং নেইনি। এখন এমপিও হয়েছে, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ঘনবসতি এলাকায় ২৮ শতক জমিতে স্থাপিত এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ৪৫০ শিক্ষার্থী। শিক্ষক আছেন ১২ জন।
স্থানীয় বাসিন্দা বুলবুলি, রবিউল ও মন্টু ব্যাপারি বলেন, এফএ মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউট নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে বছর পাঁচেক আগে এখানে টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউট ছিল। সেটিও শিক্ষার্থী না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত আছে। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন নিজেও এমপিওভুক্ত দিয়াডাঙ্গা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। তার বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে রংপুর ও ভুরুঙ্গামারীতে। নতুন এমপিও স্বীকৃতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার আপন ছোট ভাই ও চাচা অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন।
আবেগাপ্লুতে কণ্ঠে শিক্ষক রিয়াজুল জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার খেসারত দিতে হচ্ছে মাঠপর্যায়ের ত্যাগী শিক্ষকদের। তারা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওর আশায় থাকলেও নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে এবার এমপিও।
এফএ টেকনিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইনস্টিটিউটের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন পরিত্যক্ত ভবনের কথা স্বীকার করলেও জানান, কাগজপত্র সব ঠিক আছে। তবে, ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী এনে ভর্তি দেখানো হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনই শতভাগ দেখানো সম্ভব নয়। যখন পরিদর্শনে আসে তখন সেগুলোই দেখানো হয়। তার দাবি, এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য তিনি একাধিক প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। এর মধ্যে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানটি আগেই এমপিও ছিল। এবার তার নিজের দুটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এক কিলোমিটারের মধ্যে বলতে কোনো বিধি নেই। একই উপজেলায় সর্বোচ্চ ছয়টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, কুড়িগ্রামে ১৯টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ছয়টি মাদরাসা এবং ১০টি এসএসসি বিএম প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণ করলে এমপিও পাওয়া যায়। শর্তগুলো হল- প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাসের হারের ভিত্তি। অনলাইনে এসব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্তের জন্য আবেদন করেছিল।
তিনি স্বীকার করেন, জেলায় এখনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যাদের যোগ্যতা থাকার পরও এমপিওভুক্ত হয়নি। তবে এমপিও যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া, তাই পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনলাইনে কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকলেও সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে পুনর্বিবেচনা করবে এবং ব্যবস্থা নেবে।