মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে আঙুল দেখিয়ে নৃশংসতার নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন কথিত ‘সুশিক্ষিত’ নারী রোকসানা পারভিন। মোহাম্মদপুরে শিশু গৃহকর্মী জান্নাতি হত্যার ঘটনায় গৃহকর্ত্রী রোকসানা পারভিন স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা শুনলে গা শিউরে উঠবে যে কোনো বিবেকবান মানুষের। এই হত্যাকাণ্ডের সহযোগী ছিলেন রোকসানার স্বামী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাঈদ আহমেদ।গৃহকর্মী জান্নাতি হত্যা এই আসামী গা ঢাকা দিয়েছেন।
১২ বছর বয়সের কাজের মেয়ে জান্নাতি গায়ে ভীষণ জ্বর নিয়ে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের ভয়ে চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল, সেখান থেকে বাচ্চাটাকে টেনেহিঁচড়ে ফ্ল্যাট আনেন রোকসানা পারভিন। হিংস্র শ্বাপদের মতোই ঝাপিয়ে পড়েন শিশু গৃহকর্মীর ছোট্ট দেহের উপর। স্বামী সাঈদ আহমেদের উসকানিতে চলে নির্দয় প্রহর।
সইতে না পেরে জান্নাতি অচেতন হয়ে পড়লে ওই অবস্থায় তাকে দুই ঘণ্টা ফেলে রাখা হয় রান্নাঘরের উত্তপ্ত পরিবেশে। দীর্ঘসময় পরেও মেয়েটার জ্ঞান ফিরে না আসায় কথিত ‘ভদ্র ও শিক্ষিত’ রোকসানা-সাইদ দম্পতি শিশুটিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে আনার আগেই শিশুটির প্রাণ কেড়ে নেয় মৃত্যু। নির্যাতনের সময় ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন তাদের সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে ও সাইদ আহমেদের বোন। তারা কেউ নির্যাতনের সময় শিশুটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি।
হত্যার কথা স্বীকার করে গত শুক্রবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিজের নৃশংসতার ঘটনা বলেন রোকসানা পারভিন।জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকতা মোহাম্মদপুর থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত আবদুল আলীম।
রোকসানাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সাইদ আহমেদ একসময় বগুড়ায় চাকরিরত ছিলেন। জান্নাতির বাড়ি বগুড়ার গাবতলী। চার বছর আগে জান্নাতি সাইদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এরপর সাইদের পরিবারের সঙ্গে জান্নাতিও ঢাকায় চলে আসে। সাইদ আহমেদ পরিবার নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ রোডের একটি ছয় তলা ভবনের নিচতলার নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকেন।
এ দম্পতির সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া একটি ছেলে রয়েছে। গত রবিবার থেকে সাইদ ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ওই বাসায় জান্নাতি ছাড়া আরও দুজন গৃহকর্মী কাজ করেন। ঢাকায় আসার পর প্রায়ই সামান্য বিষয়ে জান্নাতির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন রোকসানা; যার স্পষ্ট ছাপ ছিল জান্নাতির নিথর দেহে। লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন সাক্ষ্য দেয় জান্নাতি কী ধরনের মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়েছে।
গত ২৪ অক্টোবর শিশু জান্নাতির বাবা মো. জানু মোল্লা মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে গৃহকর্ত্রী রুকসানা পারভীন, তার স্বামী সাঈদ আহম্মেদসহ অজ্ঞাতনামা একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করেন। ঘটনার পরপরই মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ রুকসানা পারভীনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।কিন্তু তার স্বামী এখনো পলাতক।
জান্নাতির বাবা জানু মোল্লা এজাহারে জানান, জানু মোল্লা জানান, গত ২৩ অক্টোবর সকাল ৬ টার দিকে রুকসানা পারভীন মোবাইল ফোনে জানায়, আমার মেয়ে জান্নাতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। তাকে দেখার জন্য ঢাকায় আসতে বললে আমি দ্রুত রওনা দিই। বগুড়া থেকে রওনা হয়ে দুপুর ১২টার দিকে আমি সিরাজগঞ্জ পৌঁছালে রুকসানা পারভীন আবার মোবাইলে জানান, আমার মেয়ে মারা গেছে। তখন আমি আবার বাড়িতে ফিরে যাই।
আমার শ্যালক মনিরুল ইসলাম, ফুপাতো শ্যালক আরিফুল ইসলাম, চাচা শ্বশুর সবুজ মোল্লাসহ পিকআপ যোগে রাত অনুমান তিনটার দিকে ( ২৪ অক্টোবর/ বৃহস্পতিবার) রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে গিয়ে জান্নাতির মৃতদেহ শনাক্ত করি।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রোকসানা পারভিন গৃহকর্মী হত্যায় স্বামীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য দেননি। তবে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এবং ফ্লাটের সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করা কর্মীরা জানান ওই সময় বাড়ির কর্তা সাঈদ আহমেদ বাসাতেই ছিলেন।