সম্প্রতি নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে নিজের আরেকটি সন্তানের কথা উল্লেখ করে একটি স্ট্যাটাস দেন বিখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
পাঠকদের জন্য শাওনের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘নিষাদ নিনিত ছাড়াও আমার আরও একখান পুত্র আছে। তিনি অতি মিষ্ট স্বরে আমাকে মা ডাকেন। শুধু ‘মা’ ডাকেন না- ‘শাওন মা’ ডাকেন। উনার ‘শাওন মা’ ডাকের ইতিহাসটা বলি… ২০১৮ এর কোরবানি ঈদের সরকারি ছুটির প্রথম দিন- শুক্রবার।
পুত্রদ্বয়কে নিয়ে বন্ধুদের সাথে রওনা হয়েছি ‘আরন্যক’ নামের এক ছায়াঘেরা মায়াময় রিসোর্টে। রিসোর্টটির স্বত্তাধিকারী সোহেল আহমেদ ভাই আমাদের অতিপ্রিয় একজন। ৩ গাড়ি ভর্তি করে দলবল নিয়ে যাচ্ছি সবাই। আমার গাড়িতে ‘তিনি’ এবং তার ‘মাম্মাই’ও আছেন। আমি সামনের সিটে চালকের পাশে বসে দিক নির্দেশনা দিচ্ছি!
সকাল ৮ টায় রওনা হয়েছি, ৫ ঘণ্ঠা পার করেও গাজিপুর চৌরাস্তার কাছাকাছি গিয়ে আটকে আছি! সঙ্গের বাকি দু’টো গাড়ি অন্যপথ নিয়েছে। কেন যে আমি জিপিএস এর দেখানো পথে গেলাম! সবাই বিরক্ত!
নিনিত প্রতি ৪ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পরপর জিজ্ঞেস করছে “মা আর কতক্ষণ লাগবে?” আমি জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত। হঠাৎ এক চিপা রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম আমরা। আমার গাড়িচালক গর্বিত গলায় বলল, “দেখলেন ম্যাডাম কেমন ট্রিকস খাটায়ে গাড়িটা জ্যাম থেকে বাইর করে নিয়ে আসলাম!”
ঠিক এমন সময়ে গাড়ি হার্ড ব্রেক করতে বাধ্য হল। কিছু একটা হয়েছে, খুব হইচই। সামনের দু’তিনটা গাড়ি অতিদ্রুত ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলে যাচ্ছে। আমরা এমন বেকায়দায় আছি যে এগোতেও পারছি না, গাড়ি ঘুরাতেও পারছি না!
দৌড়াদৌড়ি করা লোকজনের কাছ থেকে যা জানলাম সামনে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। লেগুনা’র সাথে ধাক্কা লেগে একজন পথচারী স্পট ডেড! বেপরোয়া লেগুনা চালককে বাঁশ নিয়ে ধাওয়া করেছে জনগণ! তারা সামনে যেই গাড়ি পাচ্ছে সেটাই ভাঙছে!
২০১৮’র সেই সময়টায় বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পরিবহন চালকদের অনিয়ন্ত্রিত চালনার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শেষ হয়েছে মাত্র। এই অবস্থায় উত্তেজিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে পড়ে কি অবস্থা হতে পারে তা সহজেই ভেবে নেয়া যায়। এমন সময় পেছনের সিট থেকে চিকন গলায় একজন জিজ্ঞেস করল- “মা আর কতক্ষণ লাগবে?”
আমি জবাব দিলাম না। সেই মুহূর্তে এই ঝামেলা থেকে কীভাবে বের হবো সেই চিন্তা করার চেষ্টা করছিলাম দ্রুত। পেছনের জন আবারো জিজ্ঞেস করলেন- “মা আর কতক্ষণ লাগবে?”
এবার আমি একটু অবাক হলাম।
প্রশ্নকর্তার কণ্ঠ তো নিনিতের নয়! পেছনে তাকানোর আগেই তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন- “শাওন মা… আর কতক্ষণ লাগবে?” এই বলে তিনি সামনে এসে আমার কোলে চড়ে বসলেন।
সেদিনের ৪ বছর বয়সী সেই রাজপুত্রের নাম শুদ্ধ স্বরবর্ণ। তিনি সামনে এসে বসার পর উত্তেজিত একদল লোক বাঁশ হাতে আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসলেও আমি জানালার কাঁচ নামানোর পর আমাকে আর কোলের ছোট বাচ্চাটিকে দেখে ভদ্রভাবে বিকল্প পথ দেখিয়ে গাড়িটি ছেড়ে দিল!
আড়াই ঘণ্টার পথ ৭ ঘণ্টায় পেরিয়ে আরন্যকে পৌঁছলাম আমরা। আর বোনাস হিসেবে আমি পেয়ে গেলাম রেডিমেড আরেকখান পুত্র। আজ (১৮ অক্টোবর) আমার পুত্র শুদ্ধ স্বরবর্ণের ৫ম জন্মদিবস। আব্বা তোকে অনেক ভালোবাসা। ‘শাওন মা’ তোর জন্য বড় একটা রেড প্রিংগেলস কিনে রেখেছি।
পুনশ্চ ১: স্বরবর্ণের মুখে ‘শাওন মা’ শুনে নিনিত সাহেবের অভিব্যক্তি- “মা একটা প্রশ্ন করি? তোমার তো দুইটা ছেলে আছেই, আরেকটা ছেলে তো তোমার আর দরকার নাই!
তাই না মা?” পুনশ্চ ২: আমাকে ‘শাওন মা’ ডাকলেও নিজের মাম্মাইকে ‘সাবা আন্টি’ ডাকেন জনাব শুদ্ধ স্বরবর্ণ। পুনশ্চ ৩: রেডিমেড পুত্রের মা ডাকের কল্যাণে বেশকিছু নতুন রিউমারের জন্ম দিয়েছিলাম গত ডিসেম্বর মাসে সেন্টমার্টিন্স যাত্রায়! সেই ভয়াবহ গল্প আরেকদিন শোনাব।’