মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমধারিদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়ান অজিজাহ। সম্প্রতি উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়ান আজিজাহ জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে চালু হওয়া সেকেন্ড হোম এর আবেদনকারীদের শুধু ১০ বছরের ভিসা দেয়া হবে। মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব দেয়া হবে না।
সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রাম ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’-এ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা পেশার চার হাজারের বেশি নাগরিক ইতোমধ্যে নাম লিখিয়েছেন মাই সেকেন্ড হোমে। এরমধ্যে অনেকে ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি স্থায়ীভাবে স্ব-পরিবারে বসবাস করছেন। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন তা বাস্তবায়নের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান মাহাথির মোহাম্মদের সরকার।
মালয়েশিয়ার মিনিস্ট্রি অ্যান্ড ট্যুরিজম আর্টস অ্যান্ড কালচারের ওয়েব সাইটের সর্বশেষ তথ্য (২০১৮ সালের জুন) অনুযায়ী পৃথিবীর ১৩০টি দেশের ৪০ হাজার নাগরিক ‘মাইয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে’র (এমএম২এইচ) বাসিন্দা হয়েছে। যারা দেশটিতে সেকেন্ড হোমের বাসিন্দা হয়েছে তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে চীনা ও দ্বিতীয় জাপানীরা। আর তালিকার তৃতীয় স্থানেই রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
পরিসংখ্যান বলছে, মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে চাইনিজ ১১ হাজার ৮২০ জন। জাপানিজ চার হাজার ১৮ জন। আর বাংলাদেশীর সংখ্যা চার হাজার ১৮ জন। এরপর যথাক্রমে ব্রিটেন দুই হাজার ৬০৮ জন, দক্ষিণ কোরিয়া দুই হাজার ৬৯ জন, সিঙ্গাপুর এক হাজার ৪২১ জন, ইরান এক হাজার ৩৮১ জন, তাইওয়ান এক হাজার ৩৪৭ জন, পাকিস্তান এক হাজার ১৭ এবং ভারতের এক হাজার আটজন।
‘মাই এক্সপার্ট’ নামক ওয়েব সাইটে বাংলাদেশীদের বর্তমান শেয়ার সর্বোচ্চ ১০ পারসেন্ট অফ দ্য টোটাল মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) প্রকল্পের বেনিফিশিয়ারি বলে উল্লেখ রয়েছে।
মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে আবেদনের ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের বয়স ৫০+ (বেশি) তাদের জন্য লিকুইড এসেট-এর পরিমাণ থাকতে হবে সাড়ে তিন লাখ মালয়েশিয়ান রিংগিত। বাংলাদেশী টাকায় ৭৩ লাখ টাকা। সাথে মাসিক আয় দেখাতে হবে ১০ হাজার মালয়েশিয়ান রিংগিত। অপরদিকে, আবেদনকারী যাদের বয়স ৫০ এর নিচে তাদের জন্য লিকুইড এসেট থাকতে হবে পাঁচ লাখ মালয়েশিয়ান রিংগিত।
ভিসা পারমিট পাওয়ার আগে যাদের বয়স ৫০ এর নিচে তাদের জন্য মালয়েশিয়ান ব্যাংকে তিন লাখ রিংগিত ফিক্সড ডিপোজিট জমা করতে হবে। আবেদনকারী এক বছর পর সেখান থেকে দেড় লাখ রিংগিত উত্তোলন করতে পারবে। তবে দ্বিতীয় বছরে অবশ্যই একই পরিমান ব্যালেন্স লেনদেনের পর জমা থাকতে হবে মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম প্রোগ্রাম পর্যন্ত। অপরদিকে, আবেদনকারী ৫০ এর ওপরে হলে দেড় লাখ রিংগিত দিয়ে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখতে হবে। এক্ষেত্রে এক বছর পর আবেদনকারী তার জমা রিংগিত থেকে ৫০ হাজার রিংগিত উত্তোলন করতে পারবে। তালিকার আবেদনকারীকে অবশ্যই এক লাখ রিংগিত ব্যাংকে ব্যালান্স টাকা জমা রাখতে হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কায় অনেকে সেকেন্ড হোম নিচ্ছেন মালয়েশিয়ায়। দেশটির শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের থেকে অনেক উন্নত, এ কারণে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামে আবেদনের হিড়িক পড়ে যায়। তবে সেকেন্ড হোম করতে যে টাকার প্রয়োজন হয় তা বাংলাদেশ থেকে কেউই বৈধ পথে নেননি।
এদিকে মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তার অজুহাতে চলছে অবৈধভাবে অর্থ পাচার। দেশটিতে সেকেন্ড হোমে বসবাসকারী অনেকের কাছেই ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি জানে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও। তবুও থামছে না এ অর্থ পাচার। কি পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব জানা যায়নি। তবে গড়ে ২০ লাখ টাকা ব্যয় ধরে দেখা গেছে, বাংলাদেশিরা নিয়ে গেছেন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই টাকা কেবল সরকারকে দিতে হয়েছে। তবে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রতি ১২ কোটি টাকা করে প্রায় ৪২ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা সেকেন্ড হোমধারীরা মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে নিয়ে গেছেন।
সেকেন্ড হোমধারীদের অর্থপাচার ও কর ফাঁকির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় যোগাযোগ অব্যাহত রাখলেও সঠিক কোন সুরাহা হয়নি এখনও। ২০১৫ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল নিয়ে একটি কমিটিও করা হয়েছিল। ওই কমিটির কার্য পরিধি সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছিল, আয়কর না দিয়ে অবৈধভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ বিদেশে পাচার বা সেকেন্ড হোম নির্মাণ করেছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এছাড়া তিন সদস্যের বিশেষ টিম সেকেন্ড হোম নেয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনুসন্ধানও চালিয়েছিল। এ ছাড়া ইমিগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদি মালয়েশিয়ান ভিসাকারীদের রয়েছে এমন তালিকা তৈরির পরই কাজ শুরুর কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে কোনটাই আলোর মুখ দেখেনি।
প্রক্রিয়া ও নিয়ম মেনেই মালয়েশিয়ার সরকারি হিসেবে বলা আছে, দেশটিতে সেকেন্ড হোম গড়েছেন ৪ হাজার ১৮ জন বাংলাদেশি। অবশ্য সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।
অপরদিকে, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ১০ থেকে ১৫ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন। আরো প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তি সেকেন্ড হোমের আবেদন করে অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, মালয়েশিয়া টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করায় বাংলাদেশিরা এই সুযোগ নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’র (আইআইইউএম) প্রফেসর এসএম আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, বাংলাদেশের সরকারকে এই বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। কেন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস করতে যাচ্ছে মানুষ। আর মালয়েশিয়া আমাদের জন্য যা করতে পারছে, আমরা কেন তা পারছি না। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ কবে অন্য দেশের মানুষের সেকেন্ড হোম হবে, সেদিকে নজর দেয়া উচিত।
সেকেন্ড হোমের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ প্রবাসী কমিউনিটি নেতা বলেন, জীবনের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা ছাড়াও মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম বানানোর অন্যতম কারণ। ওই দেশে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরাই বেশি সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। এর পরেই আছেন ব্যবসায়ীরা। তবে সেকেন্ড হোম করতে যে টাকার প্রয়োজন হয় তা বাংলাদেশ থেকে কেউই বৈধ পথে নেননি।