আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে নামার পর দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছেন যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এই সভাপতি জুয়াড়িদের কাছে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত।
সম্রাটের জুয়ার নেশাও নাকি ভয়াবহ। প্রতিমাসে ঢাকার বাইরে যান জুয়া খেলতে। নিয়মিতই নাকি সিঙ্গাপুরে গিয়ে বড় বড় জুয়ার আসরে যোগ দেন।
এসব পুরনো খবর হলেও নতুন খবর হল যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার নাও হয়ে পারেন। তার একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি জানিয়েছে, সম্রাট প্রভাবশালী মহলকে ‘ম্যানেজ’ করতে পেরেছেন।
সম্রাট বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তিনি ছাড়া ঢাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম সাংগঠনিকভাবে মোকাবেলা করা কঠিন হবে। এছাড়া তার সুবিধাভোগী নেতারাও আতঙ্কে আছেন এই ভেবে যে, সম্রাট গ্রেফতার হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সম্রাটের সুবিধাভোগীদের তালিকায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিই আছেন। এ কারণে তাকে গ্রেফতারে ইতস্তত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে কোনো মামলায় আসামিও করা হয়নি। অনেকে বলছেন, সম্রাট গ্রেফতার না–ও হতে পারেন।
ঢাকায় ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতারের বিষয়ে লুকোচুরি খেলা চলছে। কয়েকদিন ধরেই তিনি গোয়েন্দাজালে আটকে আছেন।
সম্রাট আটক হয়েছেন কিনা সেটি নিশ্চিত হতে গত দুদিন ডিএমপি ও ডিবি কার্যালয়ে মিডিয়া কর্মীদের ভিড় ছিল। কিন্তু পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা কেউ-ই এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সম্রাটকে গ্রেফতার করা হবে কিনা সেটি নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী এমনকি প্রশাসন এখনও পরিস্কার নয়। সাধারণত রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতারের আগে উপরের মহলের একটা ইশারা লাগে। এখনও সেই সবুজ সংকেত পায়নি আইনশৃংখলা বাহিনী। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী আজ দেশে ফিরেছেন। এখন তাকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হবে। এরপর তার নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সম্রাট এখন নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন। তিনি পরিবার ও দলীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। দুদিন আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্রাট গ্রেফতার এড়াতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির করার পাশাপাশি নিজের অসুস্থতার বিষয়টিও তুলে ধরে তিনি বলছেন, তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। এ কারণে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো সম্রাটের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলছে না। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের পক্ষ থেকেও তাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা সেটি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কৌশলী উত্তর দিচ্ছেন সরকারের মন্ত্রীরা। তবে সম্রাট গোয়েন্দাজালে আছেন- এ বিষয়ে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হবে কিনা, এ নিয়ে জনমনে সেই পুরনো সন্দেহ ফের উঁকি দিচ্ছে।
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের গ্রেফতার প্রশ্নে মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ওয়েট করেন, এত তাড়াহুড়া করছেন কেন।’ ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে সম্রাটকে ছাড় দেয়া হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, কাউকে ছাড় দেব এমন কোনো কথা আমরা বলিনি। যাকে আপনি গ্রেফতার করবেন, সেটা তদন্ত করে উপযুক্ত প্রমাণ নিয়েই গ্রেফতার করার মতো অবস্থা হলে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। এবং বলা আছে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে ব্যক্তিবিশেষ কোনো বিষয় নয়। ব্যক্তি যেই হোক, অপকর্ম করলে সাম্প্রতিক অভিযানের টার্গেট হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্রাটকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি নিজেই বলেছেন, ওয়েট অ্যান্ড সি (অপেক্ষা করুন এবং দেখুন কী হয়)। কাজেই ওয়েট করেন এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?
ক্যাসিনো সম্রাটের গ্রেফতার নিয়ে চলছে লুকোচুরি খেলা। তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে প্রশাসন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ সংক্রান্ত প্রশ্নের কৌশলী উত্তর দিয়েছেন। রোববার ওবায়দুল কাদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘প্লিজ, ওয়েট অ্যান্ড সি’।
শনিবার আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘অপেক্ষা করুন, যা ঘটবে দেখবেন। আপনারা অনেক কিছু বলছেন, আমরা যেটি বলছি ‘সম্রাট’ হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। ‘আমি এটি এখনও বলছি- সম্রাট বলে কথা নয়; যে কেউ আইনের আওতায় আসবে। আপনারা সময় হলেই দেখবেন।’
গত ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার অভিযান শুরুর পর ১৩ দিন পার হলো। কিন্তু অভিযানের ব্যাপ্তি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছেন না। গোয়েন্দা পুলিশ একটি মামলার তদন্ত করছে। বাকি ১৬টি মামলার তদন্ত করছে র্যাব।
সম্রাটকে গ্রেফতার করা হবে কিনা এমন প্রশ্নে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, গ্রেফতার করা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো কোনো তথ্য প্রকাশ করার পর্যায়ে নেই। তদন্তে সম্রাটের নাম আছে কি না বা তাকে আটক করা হবে কি না, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখন সবই তদন্ত পর্যায়ে আছে। আগাম কিছু বলা ঠিক হবে না।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ক্যাসিনো-কাণ্ডে যাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তারাই সম্রাটের নাম বলছেন। তার সহযোগী হিসেবে নাম আসছে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমানসহ আরও কয়েকজনের। এর মধ্যে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ও মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ গ্রেফতার হননি।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামে সম্রাটের পক্ষে তদবির চলছে। কয়েকজন নেতা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, সম্রাট গ্রেফতার হলে ঢাকায় সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়বে। বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। বিষয়টি কিছুটা আমলে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদের গ্রেফতারের পরই তাকে গ্রেফতারের কথা ছিল।
সুত্রঃ যুগান্তর