২০১২ সালের আগেও শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন কামাল হোসেন রবি ও মাহাতাব হোসেন। ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন-রাসিকের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর পরই উত্থান শুরু।
রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন বাসের হেলপার ছিলেন, এখন হাঁকান দামি পাজেরো গাড়ি। সঙ্গে রাখেন চার-পাঁচজন সহযোগী। মাহাতাবের বিরুদ্ধে আছে সংগঠনের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। পাজেরো ছাড়াও আছে তিনটি দামি বাস, রাজশাহী শহরের টিকাপাড়ায় পাঁচ তলা আলিশান ফ্ল্যাটবাড়ি আর বিপুল সম্পদ।
এই ইউনিয়নের আরেক নেতা সদ্যসাবেক আহ্বায়ক কামাল হোসেন রবির উত্থানও প্রায় একই কায়দায়। রবি বাস আর ট্রাক থেকে চাঁদা তোলেন সমানে। তিনিও চড়েন দামি গাড়িতে। আছে কয়েকটি ট্রাক, বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ। মোটর শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের কথা বলে এ দুই নেতা বাস টার্মিনালে জুয়ার আসর বসিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আবার বাস থেকে বছরের পর বছর ধরে চাঁদা তুলে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেছেন তারা।
রাসিকের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহাতাব হোসেনের বিরুদ্ধে ইউনিয়নের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, মারপিট আর লুটপাটের মাধ্যমে রাজশাহীর পরিবহন সেক্টরে এই শ্রমিকনেতা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
সম্প্রতি শ্রমিক ইউনিয়ন সদস্যদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, র্যাব-৫-এর অধিনায়ক, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার ও রাসিক মেয়রের কাছেও দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, সাধারণ কর্মচারীদের অর্থায়নে শিরোইল বাস টার্মিনালের নির্মিত ৪ কোটি টাকা মূল্যের দ্বিতল ভবন মাহাতাব হোসেন চৌধুরী স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে মাত্র ১ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। এ টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ লাখ ইউনিয়নের অ্যাকাউন্টে জমা দেন। বাকি ৭০ লাখের কোনো হিসাব আজ পর্যন্ত দাখিল করেননি তিনি। শ্রমিক ইউনিয়নের উন্নতির নাম করে মাসের পর মাস জুয়া, সার্কাস আর যাত্রাপালার আয়োজন করেছিলেন মাহাতাব। যেখান থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে ১০-১৫ লাখ টাকা উপার্জন করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের দিন মাহাতাবের বিপক্ষে অবস্থান নেন তারই একসময়ের সব অপকর্মের সহযোগী কামাল হোসেন রবি। রবির লোকজন ভোটবাক্স দখল করে নির্বাচনই ভুল করে দেন। এরপর জোর করে শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বায়কের পদটিও বাগিয়ে নেন রবি। সেই থেকে দুজনের বিরোধ চলছে। ইউনিয়নের এবারকার নির্বাচনেও মাহাতাব হোসেন সাধারণ সম্পাদক পদে অংশ নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আর রবির পক্ষের লোক আবদুল মোমিন মাহাতাবের প্রতিদ্বন্দ্বী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালের মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে মাহাতাব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরই পাজেরো গাড়ি কেনা ছাড়াও একে একে ছয়টি বিলাসবহুল বাস কিনে রাস্তায় নামান। যার মধ্যে এখনো তিনটি শ্রাবন্তী পরিবহন নাম দিয়ে চলছে। এ ছাড়া এই সময়ের মধ্যে রাজশাহী নগরীর টিকাপাড়ায় তিনি পাঁচ তলা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণসহ বিপুল টাকা-পয়সা ও সম্পদের মালিক।
মাহাতাব হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। এগুলোর সব হিসাব আমি দিয়ে এসেছি। এখন আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিশ্রম করেই আমি সম্পদ গড়েছি। বাস টার্মিনালে যাত্রাপালা ও জুয়ার টাকারও হিসাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে আরেক শ্রমিকনেতা কামাল হোসেন রবির আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও পাঁচটি ট্রাক। রবি একসময় নগরীর কালী মন্দির এলাকার একটি মাইকের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। মাইকিং করে বেড়াতেন নগরীতে। পরে বাসের হেলপার হন। এরপর সুপারভাইজার। পরে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যপদ বাগিয়ে নিয়ে ২০১৪ সালের শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সভাপতি হন। এরপর আলাদিনের চেরাগ পান তিনিও। এখন রবি কোটি টাকার মালিক। তিনিও শ্রমিকদের স্বার্থের নাম করে তোলা সব চাঁদা ও বাস টার্মিনালে বসানো জুয়ার আসর থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের মূল হোতা। আসন্ন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কামাল হোসেন রবি।
রবি বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। টাকা-পয়সার সব হিসাব সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে মাহাতাব হোসেন রাখতেন। টাকাগুলো কী করেছেন তিনিই বলতে পারবেন। তিনি অনেক হিসাবই আমাদের দিতে পারেননি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সম্পদ কতটা বেড়েছে তা সবাই জানে। আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই।