Home > শিক্ষা > শিক্ষকদের দলাদলি, ১২ কোটি টাকা বিল পরিশোধ রুটিন ভিসির

শিক্ষকদের দলাদলি, ১২ কোটি টাকা বিল পরিশোধ রুটিন ভিসির

জোড়াতালি দিয়ে চলছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য না থাকায় নানা ক্ষেত্রে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি এবং সিন্ডিকেট সভা হচ্ছে না। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলাদলি চরমে।

এক মাস উপাচার্যশূন্য থাকা অবস্থায় গত ২৫ জুন উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পান ট্রেজারার অধ্যাপক একেএম মাহবুব হাসান। এরপর থেকে আগের ভিসির অনুসারী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশকে শায়েস্তা করতে শুরু করেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী রুটিন উপাচার্য বেতন-ভাতাদি পরিশোধ ছাড়া প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু গত তিন মাসে বিভিন্ন ঠিকাদারকে প্রায় ১২ কোটি টাকার ঠিকাদারি বিল পরিশোধ করেছেন তিনি।

পাশাপাশি নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা পর্যন্ত ইচ্ছামতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান-আসেন। এসব কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।

ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, গত ২৬ মার্চ তৎকালীন উপাচার্য ড. ইমামুল হকের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এক মাসেরও বেশি সময় চলা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত ১১ এপ্রিল থেকে উপাচার্যকে ২৬ মে পর্যন্ত টানা দেড় মাসের ছুটি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই সময় উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পান ট্রেজারার একেএম মাহবুব হাসান। ছুটি কাটিয়ে গত ২৭ মে অবসরে যান উপাচার্য ইমামুল হক। সেই সঙ্গে গত ২৫ জুন উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পান ট্রেজারার মাহবুব হাসান।

এরই মধ্যে তিন মাস পার করেছেন রুটিন উপাচার্য। দায়িত্ব দেয়ার পর রুটিন দায়িত্ব থেকে পূর্ণাঙ্গ উপাচার্যের পদ পাকাপোক্ত করতে মোটা অংকের টাকা নিয়ে দৌড়ঝাঁপসহ আগের ভিসির অনুগতদের নানাভাবে শায়েস্তা করার পথ বেছে নেন মাহবুব হাসান। নতুন করে শুরু হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলাদলি।

এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। তাদের বিরোধ এরই মধ্যে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তবে সেদিকটি গুরুত্ব না দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছেন রুটিন উপাচার্য।

রুটিন উপাচার্য বেতন-ভাতাদি পরিশোধ ছাড়া প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু গত তিন মাসে পছন্দের বিভিন্ন ঠিকাদারকে প্রায় ১২ কোটি টাকার ঠিকাদারি বিল পরিশোধ করেছেন তিনি।

গত রমজান মাসে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের উদ্বোধন করেন রুটিন ভিসি। কিন্তু পরিচ্ছন্নতায় খরচ দেখিয়ে নিজের অনুগত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন তিনি।

তৎকালীন ভিসি ড. ইমামুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তহবিলে ৬৭ লাখ টাকা জমা রেখে যান। ভর্তি পরীক্ষা ইস্যুতে খরচের জন্য নতুন চেক বই তুলে ওই তহবিল থেকে কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন রুটিন ভিসি। অথচ পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য ছাড়া অন্য কেউ এই তহবিলের টাকা তুলতে পারবেন না বলে নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালার তোয়াক্কা করেননি রুটিন ভিসি।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভর্তি পরীক্ষার খরচ মেটাতে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু রুটিন ভিসি ভর্তি পরীক্ষার নামে মোটা অংকের টাকা উত্তোলন করে এখন স্থায়ী উপাচার্য হওয়ার মিশনে নেমেছেন। আগামী ৬ অক্টোবর ট্রেজারার মাহবুব হাসানের চার বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৮ ও ১৯ অক্টোবর। ভিসি কিংবা ট্রেজারার না থাকলে ভর্তি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মুরশিদ আবেদীন বলেন, ভিসি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুরকে ২৪ সেপ্টেম্বর লাঞ্ছিত করেছেন সহকারী পরিচালক (অর্থ) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান। এ নিয়ে সুব্রত কুমার রুটিন ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

কারণ রুটিন ভিসির পছন্দের লোক আতিকুর। রুটিন ভিসির প্রশ্রয় পেয়ে এভাবে অনেককে নাজেহাল করেছেন তিনি। আতিকুর টিএসসির দায়িত্বে ছিলেন। অথচ কোনো আদেশ ছাড়াই তাকে অর্থ দফতরে বসানো হয়েছে। ট্রেজারারের নির্দেশে কেবল পছন্দের লোকদেরই বিল দিচ্ছেন আতিকুর। সেই সঙ্গে অনেকের বিল আটকে দিয়েছেন।

নির্বাহী প্রকৌশলী মুরশিদ আবেদীন আরও বলেন, ট্রেজারার মাহবুব হাসান রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন ভিসির। অথচ ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও অনিয়ম করে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করেছেন। যেমন কম্পিউটার, প্রজেক্টর ক্রয় বাবদ ৭০ লাখ টাকার বিল করেছেন তিনি। রুটিন দায়িত্বে থেকে কোনোভাবেই এসব কাজ করতে পারেন না তিনি।

মো. মুরশীদ আবেদীন বলেন, সম্প্রতি ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক মন্তব্য লেখা হয়েছে। এর কোনো বিচার না হওয়ায় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ ও অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহকারী অধ্যাপক আবু জাফর মিয়া বলেন, পূর্ণাঙ্গ ভিসি না থাকায় একাডেমিক, অর্থ ও সিন্ডিকেট সভা হচ্ছে না ছয় মাস ধরে। ফলে সিলেবাস ও ফলাফল কার্যত অনুমোদন দেয়া যাচ্ছে না। খণ্ডকালীন শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে না। অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের দেয়ালে বাজে মন্তব্য লেখা হয়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থা কাটিয়ে তুলতে পূর্ণাঙ্গ ভিসি নিয়োগ দেয়া জরুরি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটির সদস্য এবং বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন দক্ষ উপাচার্য খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রী। উপচার্য নিয়োগ হলে সব সংকট কেটে যাবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন উপাচার্য ও ট্রেজারার অধ্যাপক মাহবুব হাসান বলেন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি ও বিরোধ চলছে এমন অভিযোগ ঢালাওভাবে করা ঠিক হবে না। দু’একজনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। তারা দুজনই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

মাহবুব হাসান বলেন, উন্নয়নকাজের বিল দেয়ার বিষয়ে নানা বাধ্যবাধকতা ও আইন আছে। যেসব বিল দেয়া হচ্ছে তা নিয়ম মেনেই দেয়া হচ্ছে। বিল প্রদানে অনিয়ম হচ্ছে না।